Monday, November 4, 2024

পালি ভাষার উৎপত্তি


পালি ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতেরা ভিন্নমত পোষণ করেন। কোনো কোনো পণ্ডিত অনুমান করেন প্রত্ন ভারতীয় আর্য ভাষা (old Indo-Aryan) গঠনের চারিটি স্তর। যথা, বৈদিক, সংস্কৃত, পালি এবং সাহিত্যিক প্রাকৃত। এই চারিটি ভাষার সঠিক সন তারিখ নির্ধারণ করা সহজ নয়। ভাষাতাত্বিকেরা বৈদিক ও সংস্কৃতকে প্রত্ন-ভারতীয় (O.I.A.) পর্যায়ে ফেলিয়াছেন। অবশ্য এই দুইটি ভাষা মূলত একই উৎসজাত হইলেও ইহাদের মধ্যে বহু পার্থক্য বিদ্যমান। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে বৈদিক ভাষারই সরলীকৃতরূপ সংস্কৃত এবং সংস্কৃত ক্রমশ সরলীকৃত ও রূপান্তরিত হইয়া প্রাকৃতরূপ ধারণ করিয়াছে।  বৈদিক ভাষায় ভারতীয় আর্যদের সাহিত্যকীর্তি ও দেবদেবীর বন্দনাগীতি রচিত। ইহার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় বেদ, উপনিষদ ও ব্রাহ্মণে। ইহাদের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। বৈদিক ভাষাকে পাণিনি প্রভৃতি বৈয়াকরণেরা ব্যাকরণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া একটা লিখিত শিষ্ট ভাষার সৃষ্টি করেন ইহাই বর্তমানে সংস্কৃত ভাষা নামে অভিহিত। ইহাকে সংস্কৃত, 'পরিমার্জিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া লইয়াছেন বলিয়া 'সংস্কৃত' বলা হয়। পালি মধ্য স্তরের ভাষার অন্তর্গত। প্রাচীন প্রাকৃত বা তদানীন্তন কথ্য ভাষা হইতে ইহার উৎপত্তি। ইহার উৎপত্তিকাল সঠিকভাবে নির্ধারণ করা না হইলেও খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ হইতে ৬০০ অব্দে বলিয়া অনুমান করা যাইতে পারে। বৈদিক আর্য ভাষার সহিত সংস্কৃতের ভাষায়
যে রূপ সম্পর্ক প্রাকৃত ভাষার সহিতও পালি ভাষার সেইরূপ সম্পর্ক। বৈদিক ভাষায় যেইরূপ দেবদেবীর বন্দনামূলক গীতি সাহিত্য রচিত বলিয়া উহাকে দেব ভাষা বলা হয়; সেইরূপ পালিভাষাকেও দেব ভাষা বলা যায়। কারণ এই ভাষাতেই বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ 'ত্রিপিটক' রচিত হইয়াছে। সেই হিসাবে বুদ্ধকে ভাষা আন্দোলনের প্রথম উদ্যোক্তা বলা যায়। তিনিই প্রথম কথ্যভাষায় জনসাধারণের নিকট তাঁহার নবধর্ম প্রচার করেন। বৈদিক আর্য ভাষা হইতে সংস্কৃত এবং সাহিত্যিক প্রাকৃতের ক্রমপরিণতির বহু তথ্য এই পালি ভাষার মাধ্যমে পাওয়া যাইতে পারে। কারণ সন তারিখ বিবেচনা করিলে পালি ভাষার স্থান বৈদিক আর্য ও সংস্কৃত ভাষার মাঝামাঝি। ভারতীয় আর্য ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে পালি ভাষার স্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা, উড়িয়া, হিন্দী, মৈথিলী ও অসমিয়া প্রভৃতি নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার সহিত ইহা ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। ইহা ছাড়া সিংহলী, বর্মী ও শ্যামদেশীয় ভাষাসমূহের উপরও পালি ভাষার প্রভাব সুস্পষ্ট।

এই পালি ভাষা প্রথমত কথ্যভাষা হইলেও পরে সাহিত্যের রূপ পাইয়া পুরোপুরি লিখিত ভাষায় পরিণত হয়। সিংহল ও ব্রহ্মদেশীয় পালি পণ্ডিতেরা পালিকে 'মাগধী নিরুক্তি' বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। গৌতম বুদ্ধ যে দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন সেই দেশের নাম মগধ বা পটলিপুত্র। তিনি যে ভাষায় কথা বলিতেন এবং ধর্ম প্রচার করিতেন উহার নাম পালি বা মাগধী - এই দুই ভাষার মধ্যে প্রকৃতিগত কোনো ভেদ নাই। সিংহলী পালি বৈয়াকরণেরা শুধু ইহাতে সন্তুষ্ট থাকেন নাই। তাঁহারা সংস্কৃত পণ্ডিতদের ন্যায় পালিকে দেবভাষা বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন। তাঁহারা বলেন এই পালি ভাষা মানবের আদি ভাষা। এই ভাষায় আদিকালের মানুষেরা কথা বলিতেন। স্বর্গের দেবতা ও অরণ্যে নিক্ষিপ্ত মানব শিশু পালি ভাষায় কথা বলিয়া থাকেন। সিংহলী পণ্ডিতদের মধ্যে পালি ভাষার মাহাত্ম্য সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত প্রবাদ প্রচলিতঃ

"সা মাগধী মূল ভাষা নরা যা আদি কপিপকা,

ব্রহ্মাণো চসুতালাপা সম্বুদ্ধা চাপি ভাসরে। "

মাগধী বা পালি ভাষা আদিকল্পের মানবের মূল ভাষা। সেই অশ্রুতপূর্ব ভাষায় বুদ্ধ তাঁহার নব ধর্ম প্রচার করিয়াছেন।

বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা আরও বলেন যদি কোনো শিশু ইংরেজ মাতার গর্ভে জার্মান পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করে, তবে সেই শিশু মাতাপিতার মধ্যে যাহার সঙ্গে থাকিবে তাহার ভাষায় কথা বলিবে। আর যদি সেই শিশু মাতাপিতা কাহারও সঙ্গে না থাকিয়া জঙ্গলে প্রতিপালিত হয় তবে সে মাগধী বা পালি ভাষায় কথা বলিবে, কারণ পালি তাহার সহজাত ভাষা। সমস্ত ভাষারই পরিবর্তন হয়, কেবল পালির বা মাগধী ভাষার কোনো পরিবর্তন হয় না।

পালি ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস যাহাই হউক না কেন বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারিত বাংলা ভাষার ন্যায় পালি ভাষাও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে অল্পসময়ে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করে। দেখিতে দেখিতে অসংখ্য গ্রন্থ এই ভাষায় রচিত হইয়াছে। শুধু ধর্মগ্রন্থ নহে জাতক, অবদান, মহাবংশ, দীপবংশ, চুলবংশ এবং আরও বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থ ক্রমান্বয়ে রচিত হইতে থাকে। ভাষার যথাযথ শ্রীবৃদ্ধির জন্য বিবিধ ব্যাকরণ গ্রন্থও রচিত হইয়াছে। ইহাতে দেখা যায় পালি ভাষা নিতান্ত অপাংক্তেয় অশিষ্ট লোকের ভাষা বলিয়া অবহেলা করিবার দুঃসাহস কাহারও নাই। ভগবান বুদ্ধের জ্ঞানগর্ভ উপদেশ ও সারিপুত্র, মৌদগল্পায়ন, মহাকাত্যায়ন, পূর্ণমস্তানিপুত্র, বুদ্ধঘোষ, বুদ্ধদত্ত প্রমুখ আরও বহু মনীষীর রচনায় এই ভাষা সমৃদ্ধ। বুদ্ধ বাণীর শক্তিশালী বাহক হিসাবে এই ভাষা বৌদ্ধদের কাছে পরম পবিত্র। এখনও সিংহল, বর্মা, থাইল্যাণ্ড, কম্বোডিয়া, তিব্বত, জাপান, চীন, কোরিয়া, মাঞ্চুরিয়া, প্রভৃতি সকল বৌদ্ধদেশে এই ভাষার পঠন-পাঠন, চর্চা ও গবেষণা করা হইতেছে।

সংগৃহীতঃ পালি সাহিত্যের ইতিহাস ১ম খণ্ড - রবীন্দ্রবিজয় বড়ুয়া


Facebook Page

No comments:

Post a Comment

অ- বর্ণের অভিধান - ২

  অকতাগস [ অকত+আগস] পাপ না করিয়া। =>  আগু, আগস । অকতাভিনিবেস (বিণ) অমনোযোগী। => কতাভিনিবেস । অকত্তব্ব (বিণ) অকর্তব্য, অনুচিত, যাহা কর...