Sunday, November 10, 2024

অ- বর্ণের অভিধান - ২

 অকতাগস [অকত+আগস] পাপ না করিয়া। => আগু, আগস

অকতাভিনিবেস (বিণ) অমনোযোগী। => কতাভিনিবেস

অকত্তব্ব (বিণ) অকর্তব্য, অনুচিত, যাহা করা উচিত নয়, যাহা করিবার নয়। (ক্লী) অকর্তব্য, অকর্তব্য কার্য, অনুচিত কার্য, করিবার নয় এমন কার্য।

অকত্তব্বররূপ => অকিরিযরূপ। অকিরিযরূপ। => অকত্থতি (ক্রি) অহঙ্কার না করা, আছে বলিয়া গর্ব না করা। (ব-বিণ) অকথমান।=> কথতি

অকথং কথিন (বিণ) সন্দেহমুক্ত (বর্ণনায়) অরহস্ত। (দীর্ঘনিকায় অর্থকথা বর্ণনা অনুসারে ইহার অর্থ) 'ইহা কিরূপে হইল এবং কিরূপে' ইহা না বলিয়া। (বি-ভা) তিন্ন বিচিকিচ্ছো বিহরতি - অকথঙ্কথী কুসলেসু ধর্ম্মেসু (দীর্ঘনিকায়)। ঝাযী অনেজো অকথঙ্কথিন (ধর্মপদ)।

অকথন (ক্লী) না বলা, অকথন, কথা না বলা, আলাপ না করা, (ক্রোধবশে) আলাপ না করা।

অকথনসীল (বিণ) অকথনশীল, যাহার কম কথা বলিবার অভ্যাস আছে, বাচাল নহে এমন, অনতিভাষী, অল্পভাষী।

অকদ্দম (বিণ) অকর্দম, পক্ষহীন, কর্দমমুক্ত, ধূলি কিংবা কর্দম নাই এমন, পবিত্র, পরিষ্কৃত, নিষ্পাপ।

অকনিট্‌ঠ (বিণ) অকনিষ্ঠ, ছোট নয় অথবা কনিষ্ঠ নয় এমন, ক্ষুদ্র নয় অথবা ছোট নয় এমন অর্থাৎ বৃহত্তর, ঊর্ধ্বতম। (পুং) অকনিষ্ঠ রূপব্রহ্মলোক। ইহা ডবাগ্ন বা রূপব্রহ্মলোকের ঊর্ধ্বতন ভূমির নামবিশেষ।

অকনিট্‌ঠগামিন (বিণ) অকনিষ্ঠ রূপব্রহ্মলোকে গমনকারী, যিনি ধ্যান-সাধনায় ডবাগ্ন অকনিষ্ঠ ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হইবার উপযুক্ত হইয়াছেন। পরিনিব্বাযিন।

অকনিটঠভবন- অকনিষ্ঠ  রূপব্রহ্মলোক বা ব্রহ্ম-আবাস।

অকন্তু (বিণ) অবাঞ্ছিত, অনিচ্ছিত, নিরানন্দজনক, অস্বীকার্য। কন্ত ।

অকন্তেন (ক্রি-বিণ) অকরুণ নিষ্ঠুর বচনে, কাশ কথায়, নিরানন্দ জনক বা অপ্রীতিকর কথায়।

ব্রহ্ম-আবাস।(বিণ) [অ+কন্দিত) ক্রন্দন বা বিলাপ করে না বা করে নাই এমন, অননুতপ্ত, শোকহীন। কন্দিত।

অকপণ (বিণ) [অকপণ দরিদ্র নহে এমন, ধনী। কপণ (১)।

অকল্প (বিণ) অনুপম, নিরুপম, অতুল, অতুলনীয়, কল্পনার অতীত।

অকপ্পিয (বিণ) [অ কপ্পিয) ১ আইনসঙ্গত নহে এমন, বিধিমত নহে এমন, অবৈধ, অসঙ্গত, অযোগ্য, অপ্রকৃত, অনুপযুক্ত। কপ্পিয (১)। (ক্লী) অসঙ্গত বিষয় বা ব্যাপার, অবৈধ অবস্থা, যে সব বস্তু ভিক্ষুরা গ্রহণ করিতে পারে না, অযোগ্য বা অনুপযুক্ত দ্রব্য। ২ কাল বা সময়মুক্ত, সংসারমুক্ত। (বর্ণনায়) অর্হৎ বা "অরহত"।

অকপ্পিয ভণ্ড (ক্লী) অনুপযুক্ত ভাণ্ড, যেসব বস্তু গ্রহণ ভিক্ষুদের পক্ষে নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ বস্তুর তালিকা।

অকম্প (বিণ) অকম্পিত, অসঞ্চালিত, কম্পিত হয় না এমন।

অকম্পন (বিণ) কম্পিত হয় না এমন, কাঁপে না এমন, সাহসী, নির্ভীক।

অকম্পন সভাব (পুং) অকম্পন স্বভাব, নির্ভীক অবস্থা, সাহস। অবেধ ধৰ্ম্ম। (বিণ) অকম্পন স্বভাবযুক্ত, অবিচলিত, অক্ষোভ্য, স্থির, শান্ত। অবেধ

অকম্পমান (ব-বিণ) কম্পিত হয় না এমন, অকম্পমান, দৃঢ় আছে এমন, নিরুদ্বিগ্ন, ইতস্তত করে না এমন। => কম্পিত

অকম্পিয (বিণ) অকম্পিত, অচল, কম্পনরহিত, স্থাবর, স্থির, অটল, দৃঢ়, অপরিবর্তনীয়, অপরিবর্তনশীল, কঠিন, স্থায়ী, অবিচলিত, অনুদ্বিগ্ন। কম্পিয। (ক্লী) দৃঢ়তা অর্থাৎ যাহাকে শ্রদ্ধাবল-বীর্যবল ইত্যাদি 'পঞ্চবলানি বলা হয়।

অকম্পিযত্ত (ক্লী) অকম্পিত অবস্থা, অপরিবর্তনশীলতা, দৃঢ়তা, স্থিরতা, অটলতা।

অকস্মক (বিণ) কর্মে নির্ভরশীল নহে এমন, অকর্মক বা অকর্মণ্য, কর্মসম্বন্ধীয় নহে এমন, কাজের নহে এমন, কাজে লাগে না এমন। => কম্পক

অকস্মকাম (বিণ) অলস, নিষ্কর্মা, জড়, নিষ্ক্রিয়, কাজ করিতে অনিচ্ছুক, অনুৎসাহী, অকর্মী। (বিপ) কৰ্ম্মকাম।

অকস্মজ (বিণ) অকর্মজ, কর্মফল দ্বারা অনুৎপন্ন, অকর্মসম্ভূত, কর্ম দ্বারা সংঘটিত হয় না এমন। (মিল্কিন্দ প্রশ্ন) অকস্মজ আকাস, অকস্মজ নিব্বান।

অকম্মজ আকাস-অকর্মজ শূন্যতা অর্থাৎ কর্মের ফল দ্বারা সম্ভূত হয় না এমন অবস্থা। (তুলনীয়) অকস্মজ নিব্বান।

অকস্মজ নিব্বান-পাপ ও পুণ্য যে কোনো কর্মহীন অবস্থায় শূন্যতামূলক অসম্ভূত নির্বাণ, নিরোধ বা নিবৃত্তিমূলক নির্বাণ, কর্মদ্বারা সম্ভূত নহে এরূপ নির্বাণ। ⇒ অকস্মজ।

অকস্মঞঞ (বিণ) অকর্মণ্য, অপ্রস্তুত, অনুপযুক্ত, কাজের অযোগ্য, অলস, জড়, মন্থরগতি। কস্মঞঞ।

অকস্মঞঞতা (স্ত্রী) অকর্মণ্যতা, কাজের অযোগ্যতা, অনুপযুক্ততা, জড়তা, নিষ্ক্রিয়তা, মন্থরতা, নিশ্চেষ্টতা, অক্ষমতা, যাহা সহজে নড়ানো বা সরানো যায় না এমন অবস্থা, অলসতা। (ধর্মসঙ্গণী অর্থকথা) চিত্তগেলঞঞং। (বিভঙ্গ) চেতসো লীনত্তং

বর্ণের উচ্চারণ স্থান

১। কখগঘঙ অ আ হ-ইহাদের উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ; এজন্য ইহাদিগকে কণ্ঠ্যবর্ণ (কন্ঠজা-Gutturals)  বলে।

২। চছজ ঝ ঞয ইঈ-ইহাদের উচ্চারণ স্থান তালু; এজন্য ইহাদিগকে তালব্যবর্ণ (তালুজা-Palatals) বলে।

৩। পফবভ ম উ উ-ইহাদের উচ্চারণ স্থান ওষ্ঠ; এজন্য ইহাদিগকে ওষ্ঠ্যবণ (ওটঠজা- i.abials) বলে।

8। ট ঠ ড ঢ ণর ল-হহাদের উচ্চারণ স্থান মুদ্ধা, এজন্য ইহাদিগকে মুদ্ধন্য বর্ণ (মুদ্ধজা-Linguals) বলে।

৫। ত থ দ ধনলস-ইহাদের উচ্চারণ স্থান দন্ত; এজন্য ইহাদিগকে দন্ত্য বর্ণ (দন্তজা-Dentals) বলে।

৬। এ-ইহার উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ ও তালু; এজন্য ইহাকে কণ্ঠ- তালব্য (কণ্ঠ-তালুজ বর্ণ--Gutturo-palatals) বলে 

৭। ও-হহার উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ ও ওষ্ঠ; এজন্য ইহাকে (কণ্ঠ্যৌষ্ঠ্য- বর্ণ কণ্ঠোটঠজে- Gutturo-labial) বর্ণ বলে।

৮। ব (অন্তঃস্থ।-ইহার উচ্চারণ স্থান দন্ত ও ওষ্ঠ; এজন্য ইহাকে দন্তৌষ্ঠ্য (দন্তোটঠজো-Dento-labial) বলে।

৯। ং (নিগ্‌গহাত) এর উচ্চারণ স্থান নাসিকা; ইহা স্বরবর্ণের পরে ব্যবহৃত হয়।

(১) অকবগ্নেহা কণ্ঠজা (২) হ চর তালুজা (৩) উপবঙ্গ। ওট্‌ঠজ।

(৪) ট বগরলা যুদ্ধজা (৫) ৩ বধূগণনা দপ্তজা (৬) একণ্ঠতালুজো।

(৭) ও কণ্ঠোজে। (৮) বো দণ্ডোজে।।

(৯) বিন্দুচুলামনাকারো নিগ গৃহীতং তি বুচ্চতে।

কেবলপযোগত্ত। অকারো সন্নিধীয়তে।


কয়েকটি বর্ণের নানারূপ উচ্চারণ

১; অ এই বর্ণ টীর উচ্চারণ বাঙ্গলা অ এবং আ এর মাঝামাঝি।

২। পালিতে বর্গীয় ব এবং অন্তঃস্থ ব এর উচ্চারণে বিশেষ প্রভেদ দেখা যায়। যে ব স্থানে উ উ হয়, উহা অন্তঃস্থ। যথা-বদ (উচিত), বচ্ (উত্তো)।

উ এবং ও স্তানে যে বয় উহাও অন্তঃস্থ। যথা-অনু+এতি - অন্বেতি, খে। + অস্ত্র = খুসস।

বকার ভেদ-বিষয়ে সংস্কৃত কারিকা এই:-

উদুটো যত্র বিদ্যেতে যোঃ বঃ প্রত্যয় সন্ধিজঃ।

অন্তঃস্তং তং বিজানীয়াৎ তদন্যে বর্জ্য উচাতে ॥ পালিতে অন্তঃস্থ ব কারের উচ্চারণ "উয়” এর ন্যায়।

৩। য বর্ণটীর অ্যকারের ন্যায় উচ্চারণ হয়।

৪। 'ল এই বর্ণ টার উচ্চারণ বাঙ্গালা ড় এর ন্যায়। যথা-এলক (এডক)।


Facebook Page

Monday, November 4, 2024

পালি ভাষার উৎপত্তি


পালি ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতেরা ভিন্নমত পোষণ করেন। কোনো কোনো পণ্ডিত অনুমান করেন প্রত্ন ভারতীয় আর্য ভাষা (old Indo-Aryan) গঠনের চারিটি স্তর। যথা, বৈদিক, সংস্কৃত, পালি এবং সাহিত্যিক প্রাকৃত। এই চারিটি ভাষার সঠিক সন তারিখ নির্ধারণ করা সহজ নয়। ভাষাতাত্বিকেরা বৈদিক ও সংস্কৃতকে প্রত্ন-ভারতীয় (O.I.A.) পর্যায়ে ফেলিয়াছেন। অবশ্য এই দুইটি ভাষা মূলত একই উৎসজাত হইলেও ইহাদের মধ্যে বহু পার্থক্য বিদ্যমান। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে বৈদিক ভাষারই সরলীকৃতরূপ সংস্কৃত এবং সংস্কৃত ক্রমশ সরলীকৃত ও রূপান্তরিত হইয়া প্রাকৃতরূপ ধারণ করিয়াছে।  বৈদিক ভাষায় ভারতীয় আর্যদের সাহিত্যকীর্তি ও দেবদেবীর বন্দনাগীতি রচিত। ইহার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় বেদ, উপনিষদ ও ব্রাহ্মণে। ইহাদের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। বৈদিক ভাষাকে পাণিনি প্রভৃতি বৈয়াকরণেরা ব্যাকরণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া একটা লিখিত শিষ্ট ভাষার সৃষ্টি করেন ইহাই বর্তমানে সংস্কৃত ভাষা নামে অভিহিত। ইহাকে সংস্কৃত, 'পরিমার্জিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া লইয়াছেন বলিয়া 'সংস্কৃত' বলা হয়। পালি মধ্য স্তরের ভাষার অন্তর্গত। প্রাচীন প্রাকৃত বা তদানীন্তন কথ্য ভাষা হইতে ইহার উৎপত্তি। ইহার উৎপত্তিকাল সঠিকভাবে নির্ধারণ করা না হইলেও খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ হইতে ৬০০ অব্দে বলিয়া অনুমান করা যাইতে পারে। বৈদিক আর্য ভাষার সহিত সংস্কৃতের ভাষায়
যে রূপ সম্পর্ক প্রাকৃত ভাষার সহিতও পালি ভাষার সেইরূপ সম্পর্ক। বৈদিক ভাষায় যেইরূপ দেবদেবীর বন্দনামূলক গীতি সাহিত্য রচিত বলিয়া উহাকে দেব ভাষা বলা হয়; সেইরূপ পালিভাষাকেও দেব ভাষা বলা যায়। কারণ এই ভাষাতেই বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ 'ত্রিপিটক' রচিত হইয়াছে। সেই হিসাবে বুদ্ধকে ভাষা আন্দোলনের প্রথম উদ্যোক্তা বলা যায়। তিনিই প্রথম কথ্যভাষায় জনসাধারণের নিকট তাঁহার নবধর্ম প্রচার করেন। বৈদিক আর্য ভাষা হইতে সংস্কৃত এবং সাহিত্যিক প্রাকৃতের ক্রমপরিণতির বহু তথ্য এই পালি ভাষার মাধ্যমে পাওয়া যাইতে পারে। কারণ সন তারিখ বিবেচনা করিলে পালি ভাষার স্থান বৈদিক আর্য ও সংস্কৃত ভাষার মাঝামাঝি। ভারতীয় আর্য ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে পালি ভাষার স্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা, উড়িয়া, হিন্দী, মৈথিলী ও অসমিয়া প্রভৃতি নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার সহিত ইহা ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। ইহা ছাড়া সিংহলী, বর্মী ও শ্যামদেশীয় ভাষাসমূহের উপরও পালি ভাষার প্রভাব সুস্পষ্ট।

এই পালি ভাষা প্রথমত কথ্যভাষা হইলেও পরে সাহিত্যের রূপ পাইয়া পুরোপুরি লিখিত ভাষায় পরিণত হয়। সিংহল ও ব্রহ্মদেশীয় পালি পণ্ডিতেরা পালিকে 'মাগধী নিরুক্তি' বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। গৌতম বুদ্ধ যে দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন সেই দেশের নাম মগধ বা পটলিপুত্র। তিনি যে ভাষায় কথা বলিতেন এবং ধর্ম প্রচার করিতেন উহার নাম পালি বা মাগধী - এই দুই ভাষার মধ্যে প্রকৃতিগত কোনো ভেদ নাই। সিংহলী পালি বৈয়াকরণেরা শুধু ইহাতে সন্তুষ্ট থাকেন নাই। তাঁহারা সংস্কৃত পণ্ডিতদের ন্যায় পালিকে দেবভাষা বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন। তাঁহারা বলেন এই পালি ভাষা মানবের আদি ভাষা। এই ভাষায় আদিকালের মানুষেরা কথা বলিতেন। স্বর্গের দেবতা ও অরণ্যে নিক্ষিপ্ত মানব শিশু পালি ভাষায় কথা বলিয়া থাকেন। সিংহলী পণ্ডিতদের মধ্যে পালি ভাষার মাহাত্ম্য সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত প্রবাদ প্রচলিতঃ

"সা মাগধী মূল ভাষা নরা যা আদি কপিপকা,

ব্রহ্মাণো চসুতালাপা সম্বুদ্ধা চাপি ভাসরে। "

মাগধী বা পালি ভাষা আদিকল্পের মানবের মূল ভাষা। সেই অশ্রুতপূর্ব ভাষায় বুদ্ধ তাঁহার নব ধর্ম প্রচার করিয়াছেন।

বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা আরও বলেন যদি কোনো শিশু ইংরেজ মাতার গর্ভে জার্মান পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করে, তবে সেই শিশু মাতাপিতার মধ্যে যাহার সঙ্গে থাকিবে তাহার ভাষায় কথা বলিবে। আর যদি সেই শিশু মাতাপিতা কাহারও সঙ্গে না থাকিয়া জঙ্গলে প্রতিপালিত হয় তবে সে মাগধী বা পালি ভাষায় কথা বলিবে, কারণ পালি তাহার সহজাত ভাষা। সমস্ত ভাষারই পরিবর্তন হয়, কেবল পালির বা মাগধী ভাষার কোনো পরিবর্তন হয় না।

পালি ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস যাহাই হউক না কেন বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারিত বাংলা ভাষার ন্যায় পালি ভাষাও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে অল্পসময়ে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করে। দেখিতে দেখিতে অসংখ্য গ্রন্থ এই ভাষায় রচিত হইয়াছে। শুধু ধর্মগ্রন্থ নহে জাতক, অবদান, মহাবংশ, দীপবংশ, চুলবংশ এবং আরও বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থ ক্রমান্বয়ে রচিত হইতে থাকে। ভাষার যথাযথ শ্রীবৃদ্ধির জন্য বিবিধ ব্যাকরণ গ্রন্থও রচিত হইয়াছে। ইহাতে দেখা যায় পালি ভাষা নিতান্ত অপাংক্তেয় অশিষ্ট লোকের ভাষা বলিয়া অবহেলা করিবার দুঃসাহস কাহারও নাই। ভগবান বুদ্ধের জ্ঞানগর্ভ উপদেশ ও সারিপুত্র, মৌদগল্পায়ন, মহাকাত্যায়ন, পূর্ণমস্তানিপুত্র, বুদ্ধঘোষ, বুদ্ধদত্ত প্রমুখ আরও বহু মনীষীর রচনায় এই ভাষা সমৃদ্ধ। বুদ্ধ বাণীর শক্তিশালী বাহক হিসাবে এই ভাষা বৌদ্ধদের কাছে পরম পবিত্র। এখনও সিংহল, বর্মা, থাইল্যাণ্ড, কম্বোডিয়া, তিব্বত, জাপান, চীন, কোরিয়া, মাঞ্চুরিয়া, প্রভৃতি সকল বৌদ্ধদেশে এই ভাষার পঠন-পাঠন, চর্চা ও গবেষণা করা হইতেছে।

সংগৃহীতঃ পালি সাহিত্যের ইতিহাস ১ম খণ্ড - রবীন্দ্রবিজয় বড়ুয়া


Facebook Page

অ বর্ণের অভিধান-১

অ- বর্ণমালায় স্বরবর্ণের আদ্যক্ষর বা আদ্যবর্ণ। ইহার উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ, এইজন্য ইহাকে কণ্ঠজ বর্ণ বলে।  পদান্বয়ী অব্যয়। 'আ' এর ব্যবহার উপপদরূপে বা সংক্ষিপ্তভাবে এবং দ্বিত্ব ব্যঞ্জনের পূর্বে বসে, যথা- ১. অক্কোসতি (সংস্কৃত শব্দ-আক্রোশ);২. অকখাতি (সংস্কৃত শব্দ-আখ্যা)

১. অংস (পুং, ক্লী)  অংস, স্কন্ধ, কাঁধ, স্কন্ধদেশের অর্ধাঙ্গুলি পরিমিত স্নায়ুবিশিষ্ট স্থান।  ভাগ, অংশ, খণ্ড, স্থান। (দীর্ঘনিকায়) অতীত অংসে অতীতে, পূর্বকালে, ইতঃপূর্বে, পুরাকালে, পূর্বভাগে।

২. অৎসকূট (পুং, ক্লী) অংসকূট, স্কন্ধ, কাঁধ, কণ্ঠাস্থি, স্কন্ধস্থিত মাংসপিণ্ড, যেমন--ষাঁড়ের স্কন্ধস্থিত মাংসপিণ্ড বা চোট। অংস (স্কন্ধ) স্থিত কূট (পর্বতশিখর) অর্থাৎ উন্নত মাংসপিণ্ড।

৩. অংসপুট = অসসপুট 

৪. অংসবদ্ধক (পুং, ক্লী) = অংসবট্টক। 

৫. অংসবন্ধক (পুং, ক্লী) = অংসবট্টক। 

৬. অংসবন্ধন (পুং, ক্লী) = অংসবন্ধনী, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যবহৃত একাংশিক বস্ত্র। = অংসবটুক।

৭. অংসবটুক (পুং, ক্লী) স্কন্ধচামাটি, অংসকূট সদৃশ স্কন্ধস্থিত চামড়ার থলিবিশেষ। অৎসবন্ধন।

৮. অংসবত্তক = অংসবটুক। অৎসবটুক।

৯. অংসি (পুং) (বৈদিক শব্দ: অশ্রি, অশ্রু অশনি), ধার, প্রান্ত, কোণ।

১০. অসিযতি (ক্রি) = অস্মিযে। অস্মিযে।

১১. অংসু (পুং) (সংস্কৃত-অংশু)  ১ । সূর্যরশ্মি, আলোর ছটা।  ২। সূতা, সূত্র, তত্ত্ব।

১২. অংসুক (ক্লী) কাপড়, বস্ত্র।

১৩. অংসুমালিন (পুং) সূর্য।

১৪. অংসুমালী (পুং) সূর্য। 

১৫. অইহব তুণ্ডি-কণ্টকবন (সাহিত্যে), ঘোড়ার দাঁত। অসকণ।

১৬. অকক্কস (বিণ) অকর্কশ, অবন্ধুর, মসৃণ, তেলা, চিক্কণ, নরম, কোমল, সহজ, স্নিগ্ধ, শান্ত, বাধাহীন, অপ্রতিহত। = অকাচ, অগড়িত।

১৭. অকক্কসঙ্গ (বিণ) [অ+ কক্কস অঙ্গ মসৃণ বা সুন্দর অঙ্গযুক্ত। অকক্কস।

১৮. অকঙ্খলতা = অকঙ্খলতা।

১৯. অকঙ্খল (বিণ) কর্কশ বা শক্ত নহে এমন, কোমল, নরম, হৃদয়বান, দয়ার্দ্র, সুখকর, মৃদু, মনোহর, আনন্দজনক, আমোদপ্রিয়, "প্রফুল্ল, অবন্ধুর, মসৃণ, তেলা, চিক্কণ, সহজ, স্নিগ্ধ, শান্ত, বাধাহীন, অপ্রতিহত। = অফরুস। অকক্কসঙ্গ।

২০. অকঙ্খলতা (স্ত্রী) সভ্যতা, ভদ্রতা, শান্তভাব, দয়ার্দ্রতা, প্রফুল্লতা। = সহ।

২১. অককঙ্খলভাব (পুং) শান্তভাব, দয়াভাব, ভদ্রভাব, সভ্যতা।

২২. অককখল বচত-দয়াপূর্ণ কথা, সুখকর কথা, শান্তবাক্য। = অফরুস-বাচতা, মুদুবাচতা।

২৩. অকঙ্খ (বিণ) সন্দেহমুক্ত, নিঃসন্দেহ, নিশ্চিত, যিনি সন্দেহবিমুক্ত, যিনি বিজ্জা (বিদ্যা) বা যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী, পূর্ণজ্ঞানী। (যৌগিকে) অক অপিহ অনুপম। (সুত্তনিপাত) অখিল অকঙ্খ। (তুলনীয়) বিতিন্নকঙ্খ, নিকঙ্খ।

২৪. অকঙ্খা (স্ত্রী) নিঃসন্দেহ অবস্থা, সন্দেহরহিত অবস্থা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, স্পৃহা, অপেক্ষা, জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান, সন্দেহমুক্ত অবস্থা, নিশ্চিত ভাব।

২৫. অকাঙ্খিন (বিণ) নিঃসন্দেহ, অতি বিশ্বাসী, সাহসী, সুনিশ্চিত, নিশ্চিত, বিশ্বাসযোগ্য, সন্দেহশূন্য, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য। (তুলনীয়) অকঙ্খ।

২৬. অকচ্ছু (বিণ) অকথিত। কচ্ছু (৩)।

২৭. অকট (বিণ) অকত। অকত।

২৮. অকটযূস (পুং,ক্লী) স্বাভাবিক রস, প্রাকৃতিক বা স্বভাবসিদ্ধ রস। যুস (২)।

২৯. অকটঠ (বিণ) অকর্ষিত, অপ্রস্তুত, চাষ দেওয়া হয় নাই এমন। কট্ঠ (১)।

৩০. অকঠিনতা (স্ত্রী) কঠিনতার অভাব, দৃঢ়তার অভাব, কোমলতা, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা। (বিপ) কঠিনতা। (যৌগিকে) অকঠিনতা অকক্খলতা। (তুলনীয়) অকঠিনভাব (ধর্মসঙ্গণী অর্থকথা)।

৩১. অকণ (বিণ) ক্ষুদ-কুড়াহীন, কণাহীন, ভাঙ্গা কণা নাই এমন, ঢেঁকি-ছাটা, ক্ষুদ নাই এমন, গোটা গোটা চাউল। ⇒ কণ।

৩২. অকণিকা (বিণ) দাগহীন, নির্দোষ, নিষ্কলঙ্ক, তিল নাই এমন, দোষশূন্য। (বিপ) সকণিকা। কণিকা 

৩৩. অকণ্টক (বিণ) ১ অকণ্টক, কন্টকহীন, নিষ্পন্টক, শত্রুহীন। নিক্কণ্টক। ২ (চরিত্রে) চোরের দ্বারা নিরুপদ্রব, শান্ত, বিনাক্ষতিতে, ক্লেশহীন, আরামজনক, সহজ, সোজা, সুখজনক, ক্ষতিকর নহে এমন, মুক্ত, বাধাহীন। (বিপ) সকণ্টক। (তুলনীয়) কণ্ডক। কণ্টক (৪)।

৩৪. অকণহ (বিণ) কৃষ্ণবর্ণ নহে এমন, যাহা নীচ বা হীন নহে, উজ্জ্বল, আঁধার বা কালো বর্ণ নয় এমন, অসৎ প্রকৃতির নয় বা পাপী নয় এমন, নিষ্পাপ। (দীর্ঘনিকায়) অকল্প-অসুব্ধ। (জাতক) অকণ নেত্ত-উজ্জ্বল চক্ষু (পিঙ্গলনেও রাজার বর্ণনায়, মারের চক্ষু পিঙ্গলনেত্ত হইলেও ইহা মারের বিপরীত শব্দ)। অসুব্ধ।

৩৫. অকণ নেত্ত (বিণ) উজ্জ্বল চক্ষু, যাহার চক্ষুদ্বয় উজ্জ্বল। ⇒ অকল্প।

৩৬. অকত (অ-বিণ) [অ কত, ন কত] অকৃত, করা হয় নাই এমন, প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক।

৩৭. অকতকৰ্ম্ম (বিণ) অকৃতকর্ম, যাহার কাজ এখনও সম্পন্ন করা হয় নাই, যে ব্যক্তি কাজ সম্পন্ন করিতে পারে না।

৩৮. অকতকল্যাণ (বিণ) অকল্যাণকারী, অনুপকারী, অহিতকারী, অনিষ্টকারী। কতকল্যাণ।

৩৯. অকতকিব্বিস (বিণ) সচ্চরিত্রের, সৎ, সৎকর্মী। কতকিব্বিস। (পুং) সৎ ব্যক্তি, ধার্মিক লোক।

৪০. অকতঞঞ্জু (বিণ) ১ অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন, নিমকহারাম, উপকারীর উপকার স্বীকার করে না এমন। কতগুণং অজানান্তা (জাতক অর্থকথা)। ২ পুনর্জন্মরহিত জ্ঞান অর্থাৎ নিবৃত্তি বা নির্বাণ জ্ঞান (ধর্মপদ অর্থকথা)। (জাতক) অকতঞ্জ ক্রুরাপ, অকত এ সম্ভব-অকৃতজ্ঞ স্বভাবযুক্ত।

৪১. অকতংতা (স্ত্রী) অকৃতজ্ঞতা, উপকারীর উপকার স্বীকার না করা। (যৌগিকে) অকতঞঞতা অকতবেদিতা।

৪২. অকঞঞরাপ (বিণ) অকৃতজ্ঞ স্বভাবের। অকতঞঞসম্ভব।

৪৩. অকতঞঞ সম্ভব (বিণ) অকৃতজ্ঞ প্রকৃতির। অকতঞএ।

৪৪. অকতত্তা-অসমাপ্ত রাখিয়া, অনুপস্থিতে বা কর্তব্যকর্মে অবহেলা করিয়া।

৪৫. অকতথদ্ধ (বিণ) অদৃঢ়, অশক্ত, নরম, হালকা। কতথদ্ধ।

৪৬. অকতপরিগ্রহ (বিণ) অবিবাহিত, বিবাহ করে না এমন, দারপরিগ্রহ করে নাই এমন।

৪৭. অকতপাপ (বিণ) পাপকর্ম করে না এমন, পাপহীন, নিষ্পাপ, পুণ্যবান, ধার্মিক।

৪৮. অকতপাপকৰ্ম্ম-যে পাপকার্য করে নাই। কতপাপকৰ্ম্ম।

৪৯. অকতপুঞঞ (বিণ) অকৃতপুণা, অধার্মিক, যে ব্যক্তি পুণ্যকার্য করে না বা করে নাই। (পুং) পূর্ব পূর্ব জন্মের পুণ্যহীন ব্যক্তি।

৫০. অকতপুঞতা (স্ত্রী) পুণ্যকার্য না করিবার ফলে, পূর্ব পূর্ব জন্মের সঞ্চিত পুণ্য না থাকার ফলে।

৫১. অকতমল্লক (বিণ) অকৃত্রিম, আসল, প্রকৃত, স্বাভাবিক, বিশুদ্ধ, অকপট। (বিপ) কতকমল্লক।

৫২. অকতযোগ (বিণ) কাজের অযোগ্য, অশিক্ষিত, অনাবশ্যক, অকর্মণ্য, ফলপ্রদ নয় এমন।

৫৩. অকতলুদ্দ (বিণ) দয়ালু, সৎ, ভদ্র, সাধু, অহিংস্র।⇒ কতলুদ্দ।

৫৪. অকতলুদ্ধ (বিণ) নির্লোভ, অলোভী, লোভহীন। কতলুদ্ধ।

৫৫. অকতবুদ্ধি (বিণ) মূখ, বোকা। (বিপ) কতবুদ্ধি।

৫৬. অকতহথ (বিণ) অদক্ষ, সিদ্ধহস্ত নহে এমন, অচতুর, আনাড়ি, অপ্রস্তুত, নিপুণহস্ত নহে এমন। কতহখ।


Facebook Page

পালি বর্ণমালা (The Alphabet)

 ১। পালি ভাষাতে সর্বমোট একচল্লিশটি বর্ণমালা রহিয়াছে। তন্মধ্যে স্বরবর্ণ আটটি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ তেত্রিশটি।

স্বরবর্ণ (Vowels)

অ       আ      ই       ঈ       উ    উ      এ       ও

ব্যঞ্জনবর্ণ (Consonants)

ক      খ     গ       ঘ       ঙ

চ       ছ       জ     ঝ     ঞ

ট       ঠ       ড      ঢ      ণ

ত     থ     দ       ধ        ন

প     ফ       ব       ভ      ম

য     র      ল     ৰ  স      হ

ল     ং  

২। স্বরবর্ণের মধ্যে অ, ই, উ এই তিনটি বর্ণ হইতেছে হ্রস্বস্বর বা হ্রস্বমাত্রিক;  অবশিষ্ট আ, ঈ, উ, এ ও এই পাঁচটি বর্ণ হইতেছে দীর্ঘস্বর বা দীর্ঘমাত্রিক। 

যদিও 'এ' এবং 'ও' এই বর্ণ দুইটিকে দীর্ঘস্বর বলা হইয়াছে; কিন্তু এই দীর্ঘমাত্রিক বর্ণদ্বয় যুক্তব্যঞ্জনবর্ণের আগে বসিলে হ্রস্বমাত্রিক উচ্চারিত হয়। যেমন: মেত্তা, সেষ্ঠী, ওক্কমতি, যোত্তং।

পালি লেখার জন্য রোমান ও বাংলা স্ক্রিপ্ট




পালি শব্দের উৎপত্তি

'পালি' শব্দের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে বহু গবেষণা হইয়াছে। এই গবেষণার ধারা এতই বিক্ষিপ্ত যে উহার মধ্য হইতে সঠিক তথ্য উদ্ধার করা কষ্টকর। 'পালি' শব্দের অর্থ 'পঙতি' বলিয়া কোনো কোনো পণ্ডিতের অভিমত। প্রাকৃতে 'পত্তন' হইতে 'পট্টন' হয়। তদ্রূপ 'পতি' হইতে 'পট্টি' হওয়া স্বাভাবিক। ভাষাতত্বের নিয়মানুসারে ইহার মধ্যে কোনো ধারাবাহিকতা নাই। তথাপি 'পতি' পত্তি পট্টি পাটি পাড়ি পালি অথবা পতি> পত্তি পট্টি পড়িড় পল্লি পালি বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায় না। 'পালি' শব্দের মূল অর্থ 'পঙ্ক্তি' 'বীথি' বা 'শ্রেণী' বলিয়া পূর্বাচার্যগণ বুঝাইতে প্রয়াস পাইয়াছেন। কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে কে
হই কিভাবে 'সংস্কৃত 'পতি' শব্দ হইতে 'পালি' শব্দের উৎপত্তি হইল তাহা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন নাই। সংস্কৃত 'পতি' বলিতে আমরা পদের শেষ চরণ বুঝি। যেমন 'তথাচ সূত্র পতি'। মূলগ্রন্থ বুঝাইবার জন্যও 'পঙক্তি' শব্দের প্রয়োগ হয়।ও 'পিটকত্তয়ং পালিঞ্চ ত্সস অটঠ কথঞ্চ তং' এবং 'পালিযং বুত্ত নযেন' পালিতে বা মূলে এইরূপ বহু উদাহরণ পালি সাহিত্যে পাওয়া যায়। পালি ভাষায় 'তত্ত্ব' শব্দ 'পালি' শব্দের অন্যতম প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হয়। পালি বুঝাইতেও ঐ শব্দ প্রযুক্ত হইয়া থাকে। 'তন্ত্র', 'তন্ত্রী' অথবা 'তন্ত্রি' মূলত একই শব্দ।

অধ্যাপক ভি. আপ্তে 'পালি' শব্দের অর্থ করিয়াছেন 'তন্ত্র'। পালি ভাষ্যকার বুদ্ধঘোষ 'অক্ষর পতি' বা মূল শাস্ত্র বুঝাইতে 'ঋালি' শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। যেমন, 'নেব পালিষং ন অঠকথায়ং দিস্সতি'। ইহার অর্থ পালিতে বা অর্থ কথায় কোথাও দেখা যায় না। সেইরূপ 'জম্বুদীপে পন আবুসো পালিমত্তং অথি, অঠকথা পন নথি' ভারতবর্ষে কেবল পালি বা মূল আছে, অর্থকথা বা ভাষ্যগ্রন্থ নাই। 'যো পন অথমেব সম্পাদেতি ন পালিযং - যিনি কেবল মাত্র অর্থই হৃদয়ঙ্গম করেন, তিনি পালি বা মূল আয়ত্ত করেন না। উল্লিখিত উদাহরণ হইতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে 'পালি' শব্দ প্রথমত 'মূলশাস্ত্র' বা ত্রিপিটক বুঝাইবার জন্য ব্যবহৃত হইত। পরবর্তীকালে পালি ভাষায় রচিত সমস্ত গ্রন্থ বুঝাইবার জন্য ইহার প্রয়োগ হইতে থাকে। তবে যে সমস্ত গ্রন্থ ত্রিপিটকের সহিত জড়িত নহে তদসমুদয় বুঝাইবার জন্য পালি শব্দের প্রয়োগ হয় নাই। ক্রমে ক্রমে পালি ভাষায় রচিত সমস্ত গ্রন্থেরই একনাম 'পালি' বলিয়া পরিচিত হয়। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ভগবান বুদ্ধের বাণী ও ধর্মোপদেশ যে ভাষায় রক্ষিত ও প্রতিপালিত হইয়াছে সেই ভাষাকে 'পালি ভাষা' বলে। অথবা ভগবান বুদ্ধের উপদেশ এই ভাষায় পাঠ ও রক্ষিত এই অর্থে 'পালি' বলিয়া কথিত হয়। পাঠ > পালি > পাল > পালি ব্যাকরণের ব্যুৎপত্তিগত অর্থানুসারে 'সদ্দথং পালেতী'তি পালি'- যাহা শব্দার্থকে পালন অথবা রক্ষা করে উহারই নাম পালি।

'পল্লী' ভাষা পালি ভাষা। 'পল্লী' শব্দ হইতে 'পালি' শব্দের' উৎপত্তি হইয়াছে বলিয়া কেহ কেহ অনুমান করিয়া থাকেন। 'পল্লী' বা পাড়াগাঁয়ের ভাষা পালি- এই সম্বন্ধে কোনো যুক্তিসংগত কারণ আছে বলিয়া মনে হয় না। কারণ কেবল মাগধী প্রাকৃতেই 'র' পরিবর্তিত হইয়া 'ল'-এ পরিণত হইতে দৃষ্ট হয়, পালিতে ইহা খুব বিরল। উক্ত মত সম্ভবত বৌদ্ধ ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করিবার জন্য বৌদ্ধ-বিদ্বেষী পণ্ডিতের চক্রান্ত। আবার কাহারও মতে মগধ বা পাটলিপুত্রের নামানুসারে 'পালি' শব্দের উৎপত্তি হইয়াছে। 'পাটলি' শব্দের অপভ্রংশ পালি হইতে পারেনা। পল্লী বা পাড়াগাঁয়ের ভাষা পালি ভাষা এবং 'পল্লী শব্দ হইতে পালি ভাষার উৎপত্তি হইয়াছে- এইরূপ অনুমান হয়ত করা যাইতে পারে। তবে 'পল্লী বলিতে আমাদের আধুনিক গ্রাম মনে করিলে ভুল হইবে। গ্রামেরই বিশেষ অংশকে পল্লী বলা হয়। পালি কখনও একটি ক্ষুদ্র গ্রামের ভাষা হইতে পারেনা। পালি গ্রাম ও নগর উভয় স্থলেই কথিত হইত।

সংস্কৃত 'তন্ত্রি' বা 'তন্ত্রী' (পালি তন্তি) শব্দের মূল অর্থ হইল 'রজ্জু' বা 'সূত্র'। প্রাচীন ঋষিদের রচিত সুক্তসমূহ "সূত্র' নামে পরিচিত। যেমন, 'ব্রহ্মসূত্র', 'ন্যায়সূত্র' প্রভৃতি। 'তস্তি' বা 'তন্ত্রি' শব্দ একার্থক। এইজন্য কোনো কোনো পণ্ডিত অনুমান করেন 'তস্তি' অথবা সূত্র' হইতে পালি শব্দের উৎপত্তি। বৌদ্ধ সাহিত্যেও 'তন্তি' শব্দটি 'পালির' অন্যতম প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। যথা, যেতুস্মিং তন্তি তন্তীসু নারিযং পালি কথ্যতে'।সেইরূপে 'তস্তি যা মাতিকং ঠপেসি',; 'তন্তিবসেন মাতিকা ঠপিত্বা', 'তম্ভিবসেন বিভত্তা' ইত্যাদি। এইভাবে দেখা যায় 'তন্ত্র', 'তন্তী', 'সূত্র' শব্দের ন্যায় ত্রিপিটক শাস্ত্র বুঝাইবার জন্য 'পালি' শব্দের ব্যবহার হইয়াছে।

সমসাময়িক ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে আমরা দেখিতে পাই ভগবান বুদ্ধ কোশলে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তিনি ধর্ম প্রচারের জন্যও সমগ্র উত্তর ভারত পরিভ্রমণ করেন। বাঙলা-ভারত উপ-মহাদেশের বিচিত্র সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ভাষা ও আচার- অনুষ্ঠানের সহিত তিনি সর্বোতভাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁহার জীবদ্দশাতেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিহার ও সংঘারাম প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। শ্রাবস্তী, জেতবন, পূর্বারাম, বেণুবন, নালন্দা, চাপাল চৈত্য প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা তাঁহারই তত্ত্বাবধানে হইয়াছিল।

এই বিহারগুলি শুধু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসস্থল নয়, ইহা বৌদ্ধশাস্ত্র চর্চা ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিলন কেন্দ্রও ছিল। এইখানে থাকিয়া বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিবিধ শাস্ত্র (বহু সচ্চঞ্চ সিপপঞ্চ) অধ্যয়ন করিতেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে বহু নরনারী আসিয়া এইখানে ভিড় করিত। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সংকীর্ণ গণ্ডি ত্যাগ করিয়া সংঘারামের ভাষা ও সংস্কৃত শিক্ষায় মনোনিবেশ করিতেন। দীর্ঘদিন বিহার ও সংঘারামে বাস করায় তাঁহাদের আঞ্চলিক ভাষায় কথাবার্তা বলা অসুবিধা বোধ করিতেন। তাহা ছাড়া যাতায়াতের কিছুটা অসুবিধা থাকায় অন্য অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ততটা সুযোগ ছিল না। কাজে কাজেই কালক্রমে নিজেদের মধ্যে সহজে ভাব বিনিময়ের জন্য একটা মিশ্র নূতন ভাষার সৃষ্টি হইয়াছিল। ইহাই পালি ভাষা। এই ভাষায় বিহারে পাক্ষিক ধর্মালোচনা পাতিমোক্ষ আবৃত্তি হইত। এই ধর্মসভায় ভিক্ষুদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। এই কারণে সাধারণ ভিক্ষুদের বুঝিবার জন্য একটা সর্বজনবোধ্য ভাষার প্রয়োজনীয়তা ছিল অত্যধিক। তাই পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে এই বিহারগুলিতেই পালি ভাষার উৎপত্তি হয় এবং এই ভাষাতেই বৌদ্ধ শাস্ত্র ও ত্রিপিটক গ্রন্থ রচিত ও সংরক্ষিত হইয়াছিল।

অতএব আমরা দেখিতে পাই ভগবান তথাগত বুদ্ধ মাগধী ভাষায় তাঁহার নব ধর্ম প্রচার ও শিক্ষা দিয়াছিলেন। তদনুসারে বিভিন্ন অঞ্চলের ভিক্ষু-ভিক্ষুণীরা এই মাগধী প্রাকৃতকে কেন্দ্র করিয়া 'পালিভাষা' নামে এক মিশ্র ভাষার সৃষ্টি করেন। উত্তর ভারতে প্রচলিত (তৎকালীন) প্রায় সমস্ত ভাষার শব্দসম্ভারে এই নূতন ভাষা পুষ্ট ও পরিবর্ধিত। সুতরাং পালি কেবলমাত্র পল্লীর ভাষা এই মত গ্রহণযোগ্য নহে। বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণী, শ্রমণ ও শ্রামণেরীগণের পরস্পর যোগাযোগে সৃষ্ট ইহা এক প্রকার সংকর ভাষা। কথিত আছে ভগবান তথাগত বুদ্ধ এই ভাষাতেই তাঁহার উপদেশাবলী প্রচার করিয়াছিলেন।


সংগৃহীতঃ পালি সাহিত্যের ইতিহাস ১ম খণ্ড - রবীন্দ্রবিজয় বড়ুয়া


Facebook Page

Sunday, November 3, 2024

ভারতীয় আর্যভাষার স্তর ও শ্রেণীবিভাগ-পালি শব্দের অর্থ, পালি ভাষার উৎপত্তি-প্রাকৃত শব্দের অর্থ-প্রাকৃত ভাষার বৈচিত্র্য ও মূল্যায়ন

 


ভাষার ইতিবৃত্ত এবং শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে পালি এবং প্রাকৃত ভাষাসমূহ মধ্য ভারতীয়-আর্যভাষার (Middle Indo-Aryan) অন্তর্গত। ভারতীয়-আর্যভাষা ভারতীয়-আর্যভাষার একটি স্তর। মধ্য ভারতীয়-আর্যভাষার ইতিহাসে আমরা মোটামুটি তিনটি স্তর পাই:

(ক) প্রাচীন ভারতীয়-আর্যভাষা (Old Indo-Aryan): - সাধারণভাবে এই স্তর খৃঃ পূঃ ত্রয়োদশ শতক থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষা এই স্তরের অন্তর্গত।

(খ) মধ্য ভারতীয়-আর্যভাষা (Middle Indo-Aryan):- অশোকের অনুশাসন এবং অন্যান্য প্রতুলেখের (Inscription) ভাষা, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ প্রভৃতি এই স্তরের অন্তর্গত। খৃঃ পূঃ বষ্ঠ শতক থেকে খৃষ্টীয় দশম শতক পর্যন্ত এই স্তরের আনুমানিক কাল।

(গ) নব্য ভারতীয়-আর্যভাষা (New Indo-Aryan)-হিন্দী, বাঙলা, মারাঠী প্রভৃতি ভাষাকে এই স্তরে ধরা হয়। খৃষ্টীয় দশম শতক থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত এর বিস্তৃতি।

ভারতীয়-আর্যভাষার বিবর্তন বিশ্লেষণ করলে আমরা মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষাগুলির ক্রমবিবর্তন ও পরিণতির ক্ষেত্রে চারটি স্তর লক্ষ্য করি:

(i) প্রাচীন স্তর-খৃঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত। অশোকের অনুশাসনের ভাষা ও পালিকে এই স্তরে ধরা যায়।

(ii) পরিবৃত্তি স্তর (Transitional stage) - খৃঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক থেকে খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত। খরোধী, ব্রাহ্মী প্রভৃতি লিপিতে রচিত প্রতুলেখগুলির ভাষা এই স্তরভুক্ত।

(iii) দ্বিতীয় স্তর-খৃষ্টীয় দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত এই স্তরের মধ্যে শৌরসেনী, মাহারাষ্ট্রী, মাগধী, অর্ধমাগধী প্রভৃতি প্রাকৃত ভাষাগুলিকে ধরা যায়।

(iv) তৃতীয় স্তর-খৃষ্টীয় ষষ্ঠ থেকে দশম শতক পর্যন্ত বিস্তৃত এই স্তরে আমরা অপভ্রংশ প্রাকৃতকে ধরতে পারি।

পালি ও প্রাকৃত ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনা আমাদের কাছে সাধারণভাবে অনাদৃত। এই দুই ভাষায় রচিত বিপুল সাহিত্যের রসাস্বাদন করবার চেষ্টাও আমরা করি না। ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব আয়ত্ত করতে হ'লে পালি-প্রাকৃতের জ্ঞান অপরিহার্য। পালি-প্রাকৃতের বিশেষ চর্চা না করে বাংলা, হিন্দী, মারাঠী প্রভৃতি আর্য-ভাষামূলক আধুনিক ভারতীয় ভাষা- গুলিতে ব্যুৎপন্ন হওয়া যায় না। পালি-প্রাকৃতের সঙ্গে এই ভাষাগুলির সম্বন্ধ সংস্কৃতের সঙ্গে এদের সম্পর্ক অপেক্ষা ঘনিষ্ঠ।

জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর কবল থেকে মানুষকে মুক্ত করবার প্রয়াসে ভগবান্ বুদ্ধ যে 'সত্য' প্রচার করেছিলেন, যে 'ধর্ম' জগৎকে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল, যে ধর্মের অভ্যুদয়ে ভারতবর্ষের শিল্প, সাহিত্য, ও দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে নানা উন্নতি হয়েছিল, সেই বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বিশদ জ্ঞানলাভ করতে হ'লে পালি ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনা করা কর্তব্য। বৌদ্ধধর্মের মতই জৈনধর্মও ভারতবর্ষে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং আজও এদেশে বহুলোক এই ধর্ম অবলম্বন করে জীবন যাপন করেন। জৈনধর্মকে জানতে হ'লে আমাদের প্রাকৃতভাষা ও সাহিত্যের আলোচনা না করে উপায় নেই!

বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মে তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্যই যে কেবল পালি এবং প্রাকৃত সাহিত্যের আলোচনা প্রয়োজনীয়, তা নয়। এই দুই ভাষার সাহিত্য ভাণ্ডারে বহু উপাদেয় সম্পদ আছে, সাহিত্যরসিকের উপভোগ্য বহুবিধ গ্রন্থের রসাস্বাদন করবার সুযোগ আমরা পাই এই দুই সাহিত্যের চর্চা করলে। বৌদ্ধ-জৈনযুগের ভারতবর্ষকে জানতে হ'লে এবং ভারতীয় প্রাচীন দার্শনিক মতগুলি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে এই দুই সাহিত্য আমাদের জানতেই হ'বে। বহির্ভারতে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিজয়াভিযান শুরু হয়েছিল বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করেই। এই ধর্মের মূল বাহনরূপে পালি ভাষাও দিকে দিকে প্রসার লাভ করে। সিংহল, ব্রহ্মদেশ, শ্যাম, কম্বোজ প্রভৃতি দেশে পালি ও বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রভাব আজও লক্ষ্য করা যায়। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের একটি সুস্পষ্ট রূপ পেতে হ'লে আমাদের পালি-প্রাকৃত ভাষায় সংরক্ষিত উপাদানগুলির সাহায্য নিতেই হ'বে।

পালি শব্দের মূল অর্থঃ 

'পালি' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এবং পালিভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে পণ্ডিতমহলে বিশেষ মতভেদ আছে। পঙক্তি, বীথি, শ্রেণী প্রভৃতি অর্থে 'পালি' শব্দের প্রয়োগ আছে। 'পালি' শব্দ প্রথমতঃ বৌদ্ধশাস্ত্রের মূলশাস্ত্রকে এবং পরে মূলশাস্ত্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত যে কোনও গ্রন্থকে বোঝাতে ব্যবহৃত হোত। এমন কথাও অনেকে বলেন যে মূলশাস্ত্র 'পালি' বলে, যে ভাষায় ঐ মূল বা 'পালি' লেখা হয়েছিল তাকেই কালক্রমে পালিভাষা বলা হ'ল। 'পালি' শব্দটির প্রথম প্রয়োগ আমরা বুদ্ধঘোষের অট্ঠকথার মধ্যে পাই। এই শব্দটির বহুপ্রকার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ করার চেষ্টা হয়েছে এবং বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর 'পালিপ্রকাশ' গ্রন্থে এ সম্বন্ধে খুব ভালোভাবে আলোচনা করেছেন।

পালি ভাষার উৎপত্তিঃ

পালি ভাষার উৎপত্তি কী করে হ'ল এবং এটি কোন্ অঞ্চলের ভাষা এ নিয়েও পণ্ডিতমহলে বিশেষ মতভেদ দেখা যায়। পালি একটি মিশ্র ভাষা এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ভাষার সাদৃশ্যধর্ম লক্ষ্য করে পণ্ডিতরা বিভিন্ন মত দিয়েছেন। উজ্জয়িনীকেই পালির উৎপত্তিস্থল বলে মনে করেছেন Westergaard, Kuhn প্রমুখ পণ্ডিতগণ পৈশাচীর সঙ্গে এর সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন Sten Konow; Oldenburg প্রমুখরা পালিকে কলিঙ্গের ভাষা বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন; Lüders বলেন অর্ধমাগধীর মূল প্রাচীন রূপ থেকে অনুবাদ করেই পালি সাহিত্যের সৃষ্টি; Geiger, Windisch প্রমুখ সিংহলী ঐতিহ্যকে স্বীকার করে মনে করেন বৌদ্ধধর্মের পীঠভূমি মগধই হ'ল পালির উৎপত্তিস্থল এবং মাগধীই হ'ল মূলভাষা, আবার সুনীতি চট্টোপাধ্যায় মনে করেন পালি হল পশ্চিমা ভাষা এবং শৌরসেনী প্রাকৃতেরই প্রাচীনতর রূপ। এই মতগুলির মধ্যে কোনটিই পণ্ডিতমহলে সন্তোষজনকভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। মাগধীর পক্ষে মতামতের পাল্লা ভারী হ'লেও ব্যাকরণ, প্রতুলেখ বা নাটকের মধ্যে আমরা যে মাগধী প্রাকৃতের পরিচয় পাই তার সঙ্গে পালির বিশেষ মিল দেখা যায় না।

'প্রাকৃত' শব্দের মূল অর্থঃ

'পালি'র মত 'প্রাকৃত' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নিয়েও নানা পণ্ডিতের নানা মত'! 'প্রকৃতিতে যাহা জাত' বা 'প্রকৃতি হইতে যাহা আগত' তার নামই 'প্রাকৃত'। অনেকে বলেন এই 'প্রকৃতি' হ'ল সংস্কৃত ভাষা এবং 'প্রাকৃত' ভাষা হল সংস্কৃতের বিকৃতি। কারও মতে আবার 'প্রকৃতি' অর্থাৎ স্বভাব থেকে যে ভাষা এসেছে তারই নাম 'প্রাকৃত'। যে ভাষার 'সংস্কার' বা গুণাধান করা হয়েছে তা' হ'ল 'সংস্কৃত' এবং যে ভাষা নৈসর্গিক বা স্বাভাবিক অবস্থায় আছে এবং যার কোন 'সংস্কার' করা হয়নি তা-ই হ'ল 'প্রাকৃত'। আর এক মতে সাধারণ 'প্রাকৃত' লোকের ব্যবহৃত ভাষাই 'প্রাকৃত' ভাষা। বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় পালি প্রকাশ গ্রন্থে এ বিষয়েও বিশদ আলোচনা করেছেন।

প্রাকৃত ভাষার বৈচিত্রা ও মূল্যায়ন:

'প্রাকৃত' ভাষার নানা বিভাগ আছে। ব্যাপক অর্থে পালিও অন্যতম প্রাকৃত ভাষা, এবং প্রাকৃত ভাষা বলতে আমরা যে ভাষাগুলিকে গ্রহণ করি ভাষাতত্ত্বের বিচারে পালিভাষা সেই প্রাকৃত ভাষা অপেক্ষা প্রাচীন। ধর্মীয় প্রাকৃত, সাহিত্যিক প্রাকৃত, নাটকে ব্যবহৃত প্রাকৃত, ব্যাকরণে উল্লিখিত প্রাকৃত, বর্হিভারতীয় প্রাকৃত, প্রতুলেখ-প্রাকৃত, অশোক-প্রাকৃত, প্রভৃতি নানা বিভাগে প্রাকৃত-ভাষাকে ভাগ করা যায়। পালির ন্যায় প্রাকৃতও আমাদের কাছে অনাদৃত একথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাকৃত কাব্যের সমৃদ্ধি এবং প্রাচীনেরা প্রাকৃত কাব্যের কত প্রশংসা করেছেন তার কোন খবরই আমরা রাখি না। বিষয় বৈচিত্র্যেও প্রাকৃত ভাষা অন্ত কোন ভাষার চেয়ে দীন নয়। মনে রাখা দরকার দ্রাবিড়ভাষী দক্ষিণ ভারতে প্রাকৃত ভাষার বিপুল প্রভাব ছিল এবং খৃষ্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত সাতবাহন ও পরবর্তী রাজাদের প্রশাসন কার্য প্রাকৃত ভাষাতেই সম্পন্ন হোত। খৃঃ পূঃ চতুর্থ শতক থেকে খৃষ্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত আমরা যে যে প্রধান প্রত্নলেখ, মুদ্রালিপি ইত্যাদি পাই তা' প্রধানতঃ প্রাকৃতেই রচিত। এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে ভারতীয় রচনার প্রথম পাঠযোগ্য লিখিত প্রমাণ আমরা প্রাকৃত ভাষাতেই পাইন। এখানে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে পালি ভাষায় যা কিছু রচিত সবই মুখ্যতঃ বৌদ্ধ ধর্মকে ভিত্তি করে, কিন্তু প্রাকৃত সাহিত্য সম্বন্ধে এ কথা বলা যায় না। জৈন প্রাকৃত বা অর্ধ মাগধীতে যেমন রচিত হয়েছে বিপুল জৈনশাস্ত্র, তেমনই অন্যান্য প্রাকৃতে রচিত হয়েছে দশমুহবহো, গউড়বহো প্রভৃতির মত উৎকৃষ্ট কাব্যগ্রন্থ। সিদ্ধাচার্যরা তাঁদের জ্ঞান ও সাধনার কথা প্রকাশ করেছেন অপভ্রংশে, আর অশ্বঘোষ, ভাস, শূদ্রক, কালিদাস প্রমুখ সংস্কৃত নাট্যকারেরা বিভিন্ন সাহিত্যিক প্রাকৃত ব্যবহার করেছেন তাঁদের সংস্কৃত নাটকে এবং রাজশেখর প্রাকৃতে কপূরমঞ্জরীর মত নাটক (সট্রক) রচনা করেছেন। এ ছাড়া রয়েছে পূর্বোল্লিখিত প্রত্নলেখগুলি, যাদের সংখ্যা হ'বে প্রায় দেড় হাজার। ভাষাতত্ত্ব ছাড়া ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এই প্রভুলেখগুলির বিশেষ মূল্য আছে। বাঙলা দেশে বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্যের এবং পালিভাষার আলোচনায় অল্পবিস্তর আগ্রহ দেখা গেলেও জৈন ধর্ম ও সাহিত্যের এবং প্রাকৃত ভাষার চর্চা বাংলা দেশে একরকম নেই বললেই হয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এই অবস্থার পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা কর্তব্য।

১. S. K. Chatterjee, Origin and Development of the Bengali

Language, Pp. 16 ff.

সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত, পৃঃ ৮৬

২. S. K. Chatterjee, ঐ 

৩. বিধুশেখর শাস্ত্রী, পালি প্রকাশ, প্রবেশক, পৃঃ ১-১০

8. Geiger (Tr. B. K. Ghosh), Pali Language and Literature, p. 1-7

বিধুশেখর শাস্ত্রী, ঐ পৃঃ ১১-১৩; Winternitz, History of Indian Lit. II, p. 18

S. K. Chatterjee, ঐ; B. C. Law, A History of Pali Lit. I, Introduction.

৫. "সা মাগধী মূলভাসা নরা যা' আদিকপ্লিকা..।" পয়োগসিদ্ধি, মহারূপসিদ্ধি প্রভৃতি ব্যাকরণে এই শ্লোকটি উল্লিখিত।

৬. বিধুশেখর শাস্ত্রী, ঐ, পৃঃ ১৩-১৭

৭. Woolner, Introduction to Prakrit, p. 3

বিধুশেখর শাস্ত্রী, ঐ, পৃঃ ১৮-২০

৮. বিধুশেখর শাস্ত্রা, ঐ, পৃঃ ১৮-৩৫

৯. সুকুমার সেন, ঐ, পৃঃ ৮৯-৯২; পরেশচন্দ্র মজুমদার, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ, পৃঃ ২৫০


সংগৃহীতঃ পালি সাহিত্যের ইতিহাস (রবিন্দ্র বিজয় বড়ুয়া)

ত্রিপিটক ও পালিভাষার ক্রমবিকাশ

প্রাক্-বুদ্ধ ভারতের ইতিহাস বৈদিক এবং বেদোত্তর সাহিত্যের ভিত্তিতে অনুমান নির্ভরশীল হইয়া রচিত হইয়াছে। বৌদ্ধ সাহিত্য হইতেই প্রথম ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহের অনেকটা নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। বৌদ্ধ সাহিত্য শুধু বুদ্ধকালীন ভারতের নহে প্রাক্-বুদ্ধ ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক অবস্থার উপর যথেষ্ট আলোকপাত করে। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ সাহিত্যের সূচনা হয় গৌতম বুদ্ধের ধর্মচক্র প্রবর্তনের সময় হইতে। বুদ্ধের পরিনির্বাণের অনতিকাল পরেই তদীয় শিষ্যগণ বুদ্ধবাণী সংগ্রহ করিয়া সংরক্ষণের জন্য সচেষ্ট হন। পণ্ডিতেরা মনে করেন, গৌতম বুদ্ধ আনুমানিক ৪৮৩ খৃষ্ট পূর্বাব্দে পরিনির্বাণ লাভ করিয়াছেন। বৌদ্ধ ঐতিহ্যমতে তিনি ৮০ বৎসর জীবিত ছিলেন। এই হিসাবে তাঁহার জন্ম হয় খৃঃপুঃ ৫৬৩ অব্দে। উনত্রিশ বৎসর বয়সে সমস্ত রাজৈশ্বর্ষ' ও ভোগ- বিলাস ত্যাগ করিয়া সিদ্ধার্থ গৌতম সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেন এবং উরুবিলে (বুদ্ধ গয়া) বোধিতর মূলে ছয় বৎসর তপস্যান্তে পরম সত্যজ্ঞান উপলব্ধি করিয়া ও মানুষের দুঃখমুক্তির উপায় উদ্ভাবন করিয়া জগতে বুদ্ধ রূপে খ্যাত হইলেন। তারপর দীর্ঘ ৪৫ বৎসর উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করিয়া ধর্ম প্রচার করিলেন। কালক্রমে বুদ্ধের ধর্ম' সমগ্র ভারতে এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এত বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল যে এই ধর্ম পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলির মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছে।

সম্ভবতঃ বুদ্ধের জীবদ্দশায় ত্রিপিটকের কোন গ্রন্থ রচিত হয় নাই। পালি ত্রিপিটকের অধিকাংশ সূত্র এবং ধর্মোপদেশ বুদ্ধের মুখনিঃসৃত এবং বিনয়পিটকের নিয়মাবলী বুদ্ধনির্দেশিত বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে এবং কখন, কোথায় ও কোন প্রসঙ্গে তিনি সেই উপদেশ দান করিয়াছেন অথবা উদান আবৃত্তি করিয়াছেন তাহাও বিকৃত হইয়াছে। এই সমস্ত ধর্মদেশনার কতটা যথার্থ বুদ্ধের মুখনিঃসৃত তাহা আজ জানিবার উপায় নাই, যেহেতু তাহার কোন লিখিত প্রমাণ নাই। তবে প্রতীত্যসমুৎপাদ, চতুরার্যসত্য, আর্য' অষ্টাঙ্গিকমার্গ, নির্বাণ কিংবা পরিনির্বাণের পূর্বে তিনি ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে যে সকল উপদেশ দিয়াছেন, অথবা ধম্মপদ, উদান, ইতিবৃত্তক প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁহার সংক্ষিপ্ত ভাষণ 'বুদ্ধবচন' বলিয়া উল্লিখিত, সেইগুলি যে বুদ্ধের নিজস্ব কথা তাহা বিশ্বাসযোগ্য। এইগুলি বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য, তিব্বতী ও চীনা অনুবাদেও পাওয়া যায়। অবশ্য বুদ্ধের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে কেহ কেহ যে ধর্মদেশনা করিয়াছেন তাহার নিদর্শন নিকায়গুলিতে পাওয়া যায়। গৌতমবুদ্ধ শুধু ধর্মোপদেশ দান ও ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন নাই, তিনি ভিক্ষুসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করিয়া তাঁহার প্রবর্তিত শিক্ষাপদ ও প্রাতিমোক্ষ নিয়মাবলীর মাধ্যমে শিষ্যদের পবিত্র-জীবন যাপন ও ধর্ম'সাধনার দ্বারা চরম লক্ষ্য নির্বাণোপলব্ধির জন্য পরিচালিত করিয়াছেন।

বৌদ্ধদের প্রাচীনতম সাহিত্য ধর্মদেশনা, কথোপকথন, গীতিকবিতা, আখ্যান ও সঙ্গের নিয়মাবলীর সংগ্রহ লইয়া রচিত। পালি ত্রিপিটক এই সকল সংগ্রহের বিরাট-সংগ্রহ-সংকলন। ইহা সহজেই অনুমেয় যে ত্রিপিটক সংকলন সম্পূর্ণ হইবার বহু পূর্ব হইতে ইহার অর্ন্তভুক্ত গ্রন্থগুলির রচনাকার্য' আরম্ভ হইয়াছিল এবং ইহার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে রচিত হইয়াছিল। বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে এই সংকলনের প্রথম পর্যায় সমাপ্ত হইয়াছিল বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিন মাস পরে প্রধান শিষ্যদের সহযোগিতায় স্থবির কাশ্যপের (পালি কস্সপ) সভাপতিত্বে রাজগৃহে অনুষ্ঠিত প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতিতে। এই সম্মেলনে স্থবির আনন্দ সমগ্র ধর্ম এবং স্থবির উপালি সমগ্র বিনয় আবৃত্তি করিয়াছিলেন। এই সংগ্রহে শুধু দীর্ঘনিকায়ের অর্ন্তভুক্ত ব্রহ্মজাল সুত্ত ও সামঞঞফল সূত্ত এবং বিনয়ের পাতিমোস্থের নিয়মগুলির অংশবিশেষ উল্লিখিত হইয়াছে। 'ধর্মবিনয়ের' ঠিক কতটা অংশ এই সম্মেলনে সংগৃহীত হইয়াছিল তাহা জানিবার উপায় নাই। এত অল্প সময়ে বুদ্ধের দীর্ঘ' প্রচার জীবনের সমগ্র 'বুদ্ধবচন' সংগ্রহ করিতে না পারাই স্বাভাবিক।

বিনয় চুল্লবর্গ এবং সিংহলী কাহিনী অনুসারে বুদ্ধের পরিনির্বাণের একশত বৎসর পরে বৃজিপুত্রীয় (বজিপুত্তক) ভিক্ষুদের দশটি বিনয় বিরোধী আচরণ বন্ধ করিবার উদ্দেশ্যে বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি সাতশত অহ'ৎ স্থবিরের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। এই সম্মেলনে প্রথমে বৃজিপুত্রীয়দের দশ প্রকার আচরণ বিনয় বিরোধী বলিয়া ঘোষণা করা হয় এবং তাহাদের নিগৃহীত করা হয়। ইহার পর 'ধর্মবিনয়' প্রথম সঙ্গীতির মত পুনরাবৃত্তিও সংগৃহীত হয়। দ্বিতীয় সঙ্গীতির ঐতিহাসিকত্ব সম্পর্কে আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু বুদ্ধের পরিনির্বাণের দ্বিতীয় শতাব্দীতে যে বৌদ্ধ সঙ্ঘে বিভেদ দেখা দেয় এবং ইহা কতকগুলি শাখায় বিভক্ত হইয়া পড়ে সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সিংহলী ঐতিহ্যমতে বৃজিপুত্রীয় ভিক্ষুগণ সম্মেলনে প্রত্যাখ্যাত হইয়া নিজেরা অন্য একটি সম্মেলন আহ্বান করেন এবং বিপুল সংখ্যক ভিক্ষু (দীপবংস মতে দ্বাদশ সহস্র) এই সম্মেলনে যোগদান করেন। সেই জন্য ইহা মহাসঙ্গীতি নামে খ্যাত এবং যাঁহারা মহাসঙ্গীতিতে যোগদান করিয়াছিলেন তাঁহারা মহাসাংঘিক নামে পরিচিত হইলেন। আর প্রাচীনপন্থী ভিক্ষুগণ থেরবাদী বা স্থবিরবাদী নামে অভিহিত হইলেন। এই ঘটনার ঐতিহাসিকত্ব অস্বীকার করা যায় না, কারণ পরবর্তীকালে এই দুই শাখা হইতে উদ্ভূত মহীশাসক, সর্বাস্তিবাদ, বহুশ্রুতীয়, ধর্ম'গুপ্ত, পূর্বশৈল, অপরশৈল প্রভৃতি বহু শাখায় বা সম্প্রদায়ে বৌদ্ধসংঘ বিভক্ত হইয়াছিল। দীপবংস (৫ম অধ্যায়) মতে মহাসাংঘিক ও অন্য সম্প্রদায়ের ভিক্ষুগণ জাতক, পটিসম্ভিদামগ্‌গ প্রভৃতি গ্রহগুলির পরিবর্তন সাধন করেন এবং বুদ্ধবচনের জটিল অংশগুলি বাদ দিয়া তাঁহারা নিজস্ব রচনা সংযোজন করেন। দীপবংসের বিবরণ হইতে প্রতীয়মনে হয়, সেই সময়ে উপরোক্ত গ্রন্থগুলি রচিত হইয়াছিল। পর্যন্ত অভিধর্ম পিটকের অস্তিত্ব ছিল বলিয়া মনে হয় না। তখনও দীপবংস, মহাবংস ও সমস্তপাসাদিকার বিবরণ হইতে জানা যায় যে মৌর্য' সম্রাট অশোকের (খৃঃ পুঃ ৩য় শতাব্দী) রাজত্বকালে মোগলিপুত্ত তিস্সের সভাপতিত্বে পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। এই অধিবেশনে প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতিতে আলোচিত ও গৃহীত 'ধর্ম'বিনয়' পুনরায় আলোচিত ও গৃহীত হয়। তৃতীয় পিটক অভিধম্মের অস্তিত্বের কথা এই সম্মেলনের বিবরণী হইতে জানা যায়। কথিত আছে, অনেক অবৌদ্ধ তীর্থিক লাভ-সৎকারের জন্য বৌদ্ধ সংঘে প্রবেশ করেন। তাঁহাদের সঙ্গে প্রাচীনপন্থী ভিক্ষুগণ পাক্ষিক উপোসথ পালন করিতে অস্বীকার করেন এবং তাহাতে বহুদিন পাটলিপুত্রের অশোকারাম বিহারে উপোসথ পালন স্থগিত ছিল। সম্রাট এই ঘটনা জানিতে পারিয়া একজন মন্ত্রীকে তথায় প্রেরণ করিলেন যাহাতে তিনি ভিক্ষুদিগকে উপোসথ পালনে রাজী  করাইতে পারেন। কিন্তু মন্ত্রীর অনুরোধেও ভিক্ষুগণ রাজী না হওয়ায় তিনি তাঁহাদিগকে হত্যা করিতে আরম্ভ করেন। ইহাতে ক্ষুব্ধ হইয়া অশোকের ভ্রাতা তিস্স স্থবির মন্ত্রীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া মন্ত্রী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়েন এবং সমস্ত বিষয় সম্রাটের গোচরে আনিলেন। ইহাতে সম্রাট অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং মন্ত্রীর হঠকারিতার জন্য নিজেকে দায়ী করেন। এইজন্য তিনি তদানীন্তন সংঘনায়ক মোগলিপুত্ত তিস্সের নিকট যাইয়া তাঁহার কৃত পাপকর্মে'র শাস্তি কি হইতে পারে তাহা জিজ্ঞাসা করিলেন। তদুত্তরে সংঘনায়ক বলিলেন যে সম্রাট সম্পূর্ণ নির্দোষ, কারণ উক্ত পাপকার্য তাঁহার ইচ্ছাকৃত নহে। মোগলিপুত্ত তিস্সের পরামর্শে সম্রাট সকল ভিক্ষুকে পরীক্ষা করাইলেন এবং যাঁহারা বিভজ্জবাদী নহেন অর্থাৎ বিশুদ্ধ থেরবাদী নহেন তাঁহাদের শ্বেতবস্ত্র পরিধান করাইয়া সংঘ হইতে বহিষ্কৃত করিলেন।

সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় তিস্স পাটলিপুত্রে এক সম্মেলনের আহ্বান করেন যাহা সিংহলী ঐতিহ্যে তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি নামে খ্যাত। দশমাস ব্যাপী এই সম্মেলনে প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতিতে আলোচিত ও সংগৃহীত বুদ্ধের ধর্মবিনয় পুনরায় আলোচিত ও সংগৃহীত হয়। এই সময়ে মোঙ্গলিপুত্ত তিস্স অভিধম্ম পিটকের অন্তর্ভুক্তি 'কথাবন্ধু' গ্রন্থটি রচনা করেন। এই বিবরণ হইতে বুঝা যায় যে এই সময়ে অভিধম্ম পিটক সংকলন কার্য সম্পূর্ণ না হইলেও অনেকদূর অগ্রসর হইয়াছিল। বহু পন্ডিত উপরোক্ত কাহিনী ও তৃতীয় সঙ্গীতির ঐতিহাসিকত্বে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু ইহা সত্য যে দ্বিতীয় সঙ্গীতির পর বৌদ্ধ সংঘে যে বিভেদ শুরু হইয়াছিল তদ্ধেতু দুইশত বৎসর ব্যবধানে বৌদ্ধগণ বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হইয়াছিল এবং মতবাদ ও আচার আচরণে তাঁহাদের মধ্যে যথেষ্ট বৈষম্য দেখা দিয়াছিল। সম্রাটের আনুকুল্যে যখন বিভজ্জবাদীগণ অনেক সুযোগ সুবিধা লাভ করিয়াছিল তখন অন্য সম্প্রদায়ের বৌদ্ধগণ থেরবাদ সংঘে অনুপ্রবেশ করিয়াছিল। ইহাতে প্রাচীনপন্থী থেরবাদীগণ বুদ্ধের মূল ধর্মতত্ত্ব ও বিনয়বিধি অটুট রাখিবার জন্য সচেষ্ট হইয়া সম্মেলনের আয়োজন করিয়াছিলেন। অধিবেশন হওয়া অস্বাভাবিক নহে। সুতরাং ইহা থেরবাদ সংঘের কথাবন্ধুর বিষয়বস্তু হইতেও অনুমান করা যায় যে তৃতীয় সঙ্গীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল থেরবাদী দৃষ্টি- ভঙ্গী হইতে অথেরবাদী শাখাগুলির মতাদর্শ বিশ্লেষণ করিয়া খন্ডন করা। ভিক্ষুদের শ্বেতবস্ত্র পরিধান করাইয়া বহিষ্কারের ব্যবস্থা হইয়াছিল। সিংহলী ঐতিহ্য অনুসারে এই সময় হইতে ধর্ম' ও বিনয় দুই ভাগে বিভক্ত বুদ্ধবচন তিন ভাগে অর্থাৎ ত্রিপিটকে বিভক্ত করা হয়। একই ঐতিহ্য মতে মোগলিপুত্ত তিস্স তৃতীয় সঙ্গীতির শেষে বিভিন্ন দেশে ধর্ম'-প্রচারের জন্য বিশিষ্ট ভিক্ষুদের প্রেরণ করেন। তদীয় শিষ্য অশোকপুত্র (মতান্তরে ভ্রাতা) মহিন্দথের পালি শাস্ত্রসহ সিংহল (লংকাদ্বীপ) গমন করিয়া তথায় বৌদ্ধ সংঘ প্রতিষ্ঠিত করেন। তৃতীয় সঙ্গীতিতে সংকলিত পালি ত্রিপিটক খৃঃ পুঃ প্রথম শতাব্দীতে সিংহলরাজ বট্টগামনীর তত্ত্বাবধানে প্রথম লিপিবদ্ধ করা হয়। ইহাই বর্তমান পালি ত্রিপিটক।'

'পিটক' (বিকল্পে 'পেটক') শব্দের অর্থ পাত্র বা ঝুড়ি। অন্যমতে পিটক শব্দের অর্থ ঝুড়িতে বা আধারে রক্ষিত পাণ্ডুলিপি (পুঁথি)। পিটক শব্দ ঐতিহ্য (tradition) অর্থেও প্রযোজ্য। প্রাচীন ভারতে গুরুশিষ্য পরম্পরায় মৌখিক ঐতিহ্যে শাস্ত্রাদি সংরক্ষণের রীতি প্রচলিত ছিল। লিপিবদ্ধ করিবার রীতি প্রচলিত হইবার পর এই শাস্ত্র পৃথক্ পৃথক আধারে রক্ষিত হইত। বুদ্ধবচন সংরক্ষণের জন্য শ্রেণীবিন্যস্ত রচনা সংগ্রহ অর্থে পিটক শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। বর্তমান পালি ত্রিপিটক তিনটি পিটকের সমষ্টি, যথা-১। বিনয় পিটক-বৌদ্ধ সংঘের বিবিধ কর্মে'র এবং ভিক্ষ, ভিক্ষুণীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণের নিয়মাবলী সম্পর্কিত রচনা সংগ্রহ; ২। সুত্তপিটক-বুদ্ধের ধর্মদেশনা, ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যামূলক গদ্যে পদ্যে রচিত সূত্র সংগ্রহ এবং ৩। অভিধম্মপিটক -উচ্চতর ধর্মের তত্ত্ব বা ধর্মের উচ্চতর সূক্ষ্যতত্ত্বালোচনা বিষয়ক রচনা সংগ্রহ। সুত্তপিটকে আলোচিত ধর্ম বা চিত্তবিষয়ক শিক্ষার বিশদভাবে বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যাই অভিধম্ম পিটকের প্রতিপাদ্য বিষয়।

ত্রিপিটকের বিভিন্ন গ্রন্থে। আমরা বুদ্ধবচনের নয়টি অঙ্গের (নবঙ্গ সসাসন) উল্লেখ দেখিতে পাই। নয়টি অঙ্গ হইল-১। 'সুত্ত' (সূত্র) অর্থাৎ গদ্যে ধর্মোপদেশ; ২। 'গেয়া' অর্থাৎ গদ্য ও পদ্যে মিশ্রিত ধর্মো- পদেশ; ৩। 'বেয্যাকরণ' (ব্যাকরণ) অর্থাৎ ব্যাখ্যা বা টীকা। বৌদ্ধ সংস্কৃত ও পালি নিদান কথায় ভবিষ্যদ্বাণী অর্থে বেয্যাকরণ শব্দটি প্রযুক্ত হইয়াছে। ৪। 'গাথা' অর্থাৎ ছন্দোবদ্ধ রচনা বা কবিতা; ৫। 'উদান' অর্থাৎ সারবান সংক্ষিপ্ত আবেগময় উক্তি; ৬। ইতিবৃত্তক অর্থাৎ 'ইহা ভগবান বলিয়াছেন' এইরূপ উক্তি আরম্ভ করিয়া ক্ষুদ্র ভাষণ; ৭। 'জাতক' অর্থাৎ বুদ্ধের অতীত জীবনের কাহিনী; ৮। 'অব্‌ভূতধৰ্ম্ম' (অদ্ভুত ধর্ম') অর্থাৎ অলৌকিক ক্রিয়ার বিবরণ; ৯। 'বেদল্ল' অর্থাৎ প্রশ্নোত্তর বা কথোপকথনে ধর্মোপদেশ। বুদ্ধবচন বা শান্তার শাসনের এই 'নবাঙ্গ' কিন্তু ত্রিপিটকের বিভিন্ন বিভাগ নহে কিংবা ত্রিপিটকের বিশেষ বিশেষ গ্রহকেও বুঝায় না। ইহার দ্বারা পালি শাস্ত্রের বিভিন্ন রচনা পদ্ধতির শ্রেণীবিন্যাস করা হইয়াছে। বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যেও নবাঙ্গের সমতুল বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই নয় প্রকার অঙ্গ বা রচনা পদ্ধতির উল্লেখ হইতে প্রমাণিত হয় বর্তমান আকারে যখন ত্রিপিটক সংকলিত হয় তাহার পূর্বে এই নয় প্রকার রচনার অস্তিত্ব ছিল। অধিকন্তু, সেই সময়ে 'নবাঙ্গ' ছাড়াও বহু, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থ, বিনয় নিয়মাবলী, সূত্র, কথিকা, নীতিকথামূলক গাথা এবং অট্ঠকবঙ্গের মত সূত্র সংগ্রহ বুদ্ধবচনরূপে ত্রিপিটকে পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ এই সমস্ত সূত্র ক'ঠস্থ করিতেন। বারে বারে আবৃত্তি করিতেন এবং ব্যাখ্যা করিতেন, যাহাতে সকলেই বুদ্ধের ধর্ম-বিনয় যথার্থরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন। এইভাবে বুদ্ধবচন দীর্ঘকাল প্রচলিত থাকিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল। ভিক্ষুদের মধ্যে বহু 'সুত্তস্তিক' অর্থাৎ সূত্রের আবৃত্তিকারী, 'ধম্মকথিক' অর্থাৎ ধর্ম'তত্ত্বের প্রচারক এবং 'বিনয়ধর' অর্থাৎ বিনয় নিয়মাবলী সম্পর্কে' বিশারদ ছিলেন বলিয়া বিনয় পিটকে উল্লেখ আছে।

বর্ষাবাসের সময় যখন বহু পণ্ডিত ভিক্ষু বিহারে সমবেত জীবন যাপন করিতেন তখন অন্য ভিক্ষুগণ ধর্ম বিনয়ের জটিল অংশগুলি তাঁহাদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিবার সুযোগ পাইতেন। সম্ভবতঃ বিহারের কোন পণ্ডিত ভিক্ষু অথবা ভিক্ষুসংঘ কোন বিষয় ধর্ম' বা বিনয়ের অঙ্গীভূত বলিয়া ঘোষণা কবিবার পূর্বে উক্ত বিষয় শাস্তার (বুদ্ধের ধর্মে'র বা বিনয়ের অনুরূপ কিনা তাহা পরীক্ষা করিয়া লইতেন। বিষয়ের যথার্থতা অনুসন্ধান করিবার মত কোন বিনয়ে পারদর্শী পণ্ডিত ভিক্ষু বর্তমান ছিলেন। এইরূপ পণ্ডিত ভিক্ষুদের সম্পর্কে' বলা হইয়াছে, ধম্মধরা বিনয়ধরা মাতিকাধরা' অর্থাৎ বহুশ্রুত, শাস্ত্র ইহাতে মনে হয় সেই সময় প্রামাণ্য গ্রন্হ কিংবা ধর্ম' ত্রিপিটকের অনেক স্কুলে 'বহুস্তা আগতাগমা বিশারদ, ধর্ম বিশারদ, বিনয় বিশারদ ও মাতৃকা বিশারদ। ধর্ম ও বিনয় নিয়মাবলী সম্পর্কিত সংক্ষিপ্তরূপকে মাতিকা বলা হয়। ইহাতে মনে হয় ধর্ম সম্পর্কিত সুত্তপিটক এবং বিনয় নিয়মাবলী সম্পর্কিত বিনয় পিটক অভিধর্ম পিটকের পূর্বে সংকলিত হইয়াছে। আবার মাতৃকা পদ্ধতি অভিধর্ম পিটকের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে কথাবন্ধু অভিধর্ম পিটকের গ্রন্থ- গুলির মধ্যে সর্বশেষে রচিত এবং ইহাই একমাত্র গ্রন্থ যাহার রচয়িতার নাম সিংহলী ঐতিহ্য হইতে জানা গিয়াছে। সম্ভবতঃ খৃঃ পুঃ ৩য় শতাব্দীর পূর্বে অভিধম্ম পিটকের গ্রন্থগুলির রচনা আরম্ভ হইয়াছিল। ৪

যে বুদ্ধবচনকে ভিত্তি করিয়া ত্রিপিটক সংকলিত হইয়াছিল সেই বুদ্ধবচন তথা ত্রিপিটকের ভাষার প্রশ্নও তাহার সঙ্গে জড়িত। ত্রিপিটকের ভাষা পালি ভাষা নামে খ্যাত। পরবর্তীকালে সিংহল, ব্রহ্মদেশ, শ্যাম প্রভৃতি দেশে ত্রিপিটক বহির্ভূত বহু পালি গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। ভাষারূপে পালি শব্দের ব্যবহার খুব সাম্প্রতিক কালের। আধুনিক ইউরোপীয় পন্ডিতগণ অথবা সিংহলী বৌদ্ধগণ পালিভাষা নামকরণ করিয়াছেন বলিয়া মনে হয়।"

আচার্য বুদ্ধঘোষের সময়ে (খৃষ্টীয় ৫ম শতাব্দী) 'পালি' শব্দটি ত্রিপিটকের মূল গ্রন্থ বুঝাইতে প্রযুক্ত হইত। চুল্লবর্গে উল্লিখিত আছে: "পালিমত্তং ইধানীতং ন অঠকথা এব" অর্থাৎ পালিই শুধু এইখানে (সিংহল) আনীত হইয়াছে, অর্থকথা (টীকা) নহে। বুদ্ধঘোষ নিজেও তাঁহার অর্থ- কথাগুলিতে পালি শব্দটি একই অর্থে প্রয়োগ করিয়াছেন। অর্থকথায় পালি শব্দের প্রতিশব্দরূপে বৃদ্ধবচন, ত্রিপিটক, তন্তি, পরিয়ত্তি প্রভৃতি শব্দগুলি পাওয়া যায়। আবার সিংহলী ঐতিহ্যে ত্রিপিটকের ভাষাকে অর্থাৎ পালির ভাষাকে বলা হইয়াছে মাগধী নিরুক্তি অর্থাৎ মগধের ভাষা। বুদ্ধঘোষও বৃদ্ধবচনের ভাষাকে মাগধী নিরুক্তি বলিয়াছেন। যদিও বুদ্ধ তাঁহার প্রচার জীবনের অধিকাংশ সময় মগধ অঞ্চলের মধ্যে অতিবাহিত করিয়াছিলেন তথাপি ইহা বলা যথেষ্ট নহে যে বুদ্ধ একমাত্র মাগধী ভাষাতেই ধর্ম প্রচার করিয়াছেন। ইহা সিংহলী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উদ্ভাবন মাত্র। বুদ্ধ কোশল অঞ্চলেও অধিকাংশ সময় অতিবাহিত ও ধর্ম প্রচার করিয়াছেন এবং অবন্তী, শূরসেন, বৎস, কুরু, পাণ্ডাল, শাক্য, মল্ল প্রভৃতি মধ্য ভারতের (পালি মজঝিমদেস) বিভিন্ন মহাজনপদে, বিভিন্ন নগরে, গ্রামে, গঞ্জে ধর্ম প্রচার করিয়াছেন। সেই সকল জনপদেও আঞ্চলিক উপভাষা প্রচলিত ছিল। এখন প্রশ্ন হইতেছে, বুদ্ধ কি কোন নির্দিষ্ট একটি ভাষাতে ধর্মপ্রচার করিতেন  কিংবা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে ধর্মপ্রচার করিতেন? ইহা নিশ্চিত যে বুদ্ধ যখন যে অঞ্চলে গিয়াছেন তথাকার স্থানীয় অধিবাসিদের বোধগম্য ভাষায় ধর্মোপদেশ দিয়াছেন। আমাদের সৌভাগ্যবশতঃ বিনয় চুল্লবঙ্গে (পৃঃ ১৩৯) এমন একটি ঘটনার বিবরণ উল্লিখিত হইয়াছে যাহা হইতে বুদ্ধবচনের ভাষার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ঘটনাটি এইরূপ: সেই সময়ে যমেল ও তেকুল নামে ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব দুই ভ্রাতা ভিক্ষু ভগবান বুদ্ধের নিকট আসিয়া বলিলেন, 'ভদন্ত! এখন বিভিন্ন কুল, বিভিন্ন গোত্র ও বিভিন্ন জাতি হইতে প্রব্রজিত ভিক্ষুগণ স্বকীয় নিরুক্তি (পালি-সকায় নিরুত্তি) দ্বারা প্রচার করিয়া বুদ্ধবচনকে দূষিত (বিকৃত) করিতেছেন, ভদন্ত! এখন হইতে আমরা ছন্দসে বুদ্ধবচন ভাষান্তরিত (অনূদিত) করিব।' বুদ্ধ তাঁহাদিগকে তিরস্কার করিয়া বলিলেন, 'হে মুঢ়গণ! তোমরা কী বলিতেছ, এখন আমরা বুদ্ধবচন ছন্দসে ভাষান্তরিত করিব! ইহাতে তথাগতের প্রতি অপ্রসন্নগণ প্রসন্ন হইবেন না এবং প্রসন্নদেরও প্রসন্নতা বর্ধিত হইবে না'। এই প্রসঙ্গে তিনি অনুশাসন দিলেন, 'ভিক্ষুগণ! তোমরা বুদ্ধবচনকে ছন্দসে ভাষান্তরিত করিবে না; করিলে দুষ্কৃত আপত্তি (দোষ) হইবে। ভিক্ষুগণ! আমি অনুমোদন করিতেছি তোমরা 'সকায় নিরুত্তি'তে বুদ্ধবচন শিক্ষা কর।'

আচার্য' বুদ্ধঘোষ ছন্দস শব্দের অর্থ করিয়াছেন 'বৈদিক সংস্কৃত' (পালি- বেদং বিয় সক্কত ভাষায় বাচনামঙ্গং) এবং 'সকানিরুত্তি' শব্দের অর্থ করিয়াছেন বুদ্ধ ব্যবহৃত মাগধী ভাষা (পালি-এখ সকা নিরুত্তি নাম সম্মা সম্বন্ধেন বৃত্তপকারো মাগধকো বোহারো)। ইহা উল্লেখযোগ্য যে 'সংস্কৃত' শব্দটি ভাষারূপে বুদ্ধ ও পাণিনির পরবর্তীকালে প্রচলিত হইয়াছে। পাণিনির মতে ভাষা দুই প্রকার (১) বৈদিক এবং লৌকিক (প্রচলিত) এবং ছন্দস হইতেছে সংস্কৃতের লৌকিক রূপ হইতে ভিন্ন বৈদিক ভাষা। সম্ভবতঃ বুদ্ধও ছন্দস বলিতে তদানীন্তনকালে অপ্রচলিত প্রাচীন বৈদিক ভাষাকে বুঝাইয়াছেন। 'সকা নিরুত্তি' শব্দে বুদ্ধের প্রচার মাধ্যমরূপে মাগধী ভাষা বলিয়া বুদ্ধঘোষ যে অভিমত দিয়াছেন তাহা মানিয়া লওয়া কঠিন। বুদ্ধের মত বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন চিন্তানায়ক যে তাঁহার ধর্মপ্রচারের মাধ্যমরূপে মাগধী উপভাষাই একমাত্র নির্ভুল এবং অন্য উপভাষাগুলি ত্রুটিপূর্ণ বলিয়া মত পোষণ করিবেন তাহা মানিয়া লওয়া কঠিন। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধঘোষ আমাদের বিভ্রান্ত করিয়াছেন। চুল্লবর্গ বিবরণ হইতে প্রতীয়মান হয় যে 'সকানিরুত্তি' শব্দের অর্থ স্বকীয় ভাষা বা স্থানীয় আঞ্চলিক উপভাষা (local dialect) অর্থ হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। পরবর্তীকালের ইতিহাসও ইহার সাক্ষ্য দেয়। বুদ্ধের জীবদ্দশায় ও পরিনির্বাণের পর বৌদ্ধধর্ম' সমগ্র উত্তর ভারতে এবং দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশে বিস্তৃত হইয়াছিল। দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির পর যখন বৌদ্ধ সংঘ নানা শাখায় বিভক্ত হইয়াছিল তখন বুদ্ধবচনকে ভিত্তি করিয়া তাঁহারা নিজেদের পৃথক পৃথক শাস্ত্র সংকলন করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে হৈমবত, ধর্ম'গুপ্ত, কাশ্যপীয়দের শাস্ত্র কোন কোন ভাষায় রচিত হইয়াছিল তাহা আমাদের সঠিক জানা নাই। সেইগুলি কেবল চীনা অনুবাদেই পাওয়া গিয়াছে। চীনা অনুবাদ ও মধ্য এশিয়ায় প্রাপ্ত প্রাকৃত ধর্ম'পদের ভাষা বিশ্লেষণ করিয়া মনে হয় ধর্ম'গুপ্তদের শাস্ত্র উত্তর- পশ্চিম ভারতে প্রচলিত প্রাকৃত ভাষায় লিখিত হইয়াছিল। ঐ অঞ্চলে প্রাপ্ত অশোক শিলালিপির ভাষার সহিত যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। মহাসংঘিক ও সম্মিতীয়দের শাস্ত্র প্রাকৃতবহুল মিশ্র সংস্কৃতে রচিত হইয়াছিল। সর্বান্তিবাদ ও মূল সবাস্তিবাদীদের শাস্ত্র আদিতে মিশ্র সংস্কৃত ও পরে বিশুদ্ধ সংস্কৃতে রচিত হইয়াছিল। এই সম্প্রদায়ের সংকলিত সম্পূর্ণ সংস্কৃত পিটক পাওয়া গিয়াছে যাহার সহিত পালি ত্রিপিটকের বিষয়গত ও বিন্যাসগত সাদৃশ্য আছে। পালি ত্রিপিটক একান্তভাবে থেরবাদী বা বিভজ্জবাদীদের অবদান। শাস্ত্র রচনার জন্য বিভিন্ন শাখা তাহাদের প্রধান কেন্দ্রগুলির স্থানীয় উপভাষা এবং ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভব পণ্ডিত ভিক্ষুগণ সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়।

বিভিন্ন অঞ্চল, কুল, গোত্র, জাতি হইতে আগত ভিক্ষুগণ তাঁহাদের স্বকীয় ভাষা অর্থাৎ আঞ্চলিক উপভাষায় বুদ্ধবচন শিক্ষা করিবার জন্য অনুমতি দান করিলেও তাহার ফলে যাহাতে সংঘমধ্যে ভিক্ষুদের পারস্পরিক শাস্ত্রালোচনা তথা ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যার বিঘ্ন না হয় তজ্জন্য বুদ্ধ সচেতন ছিলেন বলিয়া মনে হয়। এই বিঘ্নের কারণ ভিক্ষুদের নিজস্ব জনপদের ভাষার প্রতি অত্যাসক্তি। এই অত্যাসক্তি হইতে যাহাতে ভিক্ষুগণ মুক্ত থাকিতে পারেন সেই জন্য তিনি তাঁহাদের সতর্ক করিয়া দেন। মঝিমনিকায়ের 'অরণবিভঙ্গ' সুত্তের নিম্নোদ্ধৃত অনুচ্ছেদ এই সম্পর্কে' আলোকপাত করে:

"ভিক্ষুগণ! জনপদ নিরুক্তিতে (স্থানীয় উপভাষা) অভিনিবেশ করা ও স্থানীয় সংজ্ঞায় (শব্দ বা পদ) অধিক গুরুত্ব আরোপ করা উচিত নহে, ইহা কথিত হইয়াছে। ইহা কেন উক্ত হইয়াছে? কিরূপে জনপদ নিরুক্তিতে অভিনিবেশ ও স্থানীয় সংজ্ঞায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়? ভিক্ষুগণ! বিভিন্ন জনপদের লোকেরা একই জিনিষকে কোথায়ও 'পাতি', কোথায়ও 'পাত্র', কোথায়ও 'বিস্থ', কোথায়ও 'শরাব', কোথায়ও 'ধারোপ', কোথায়ও 'পোণ', আবার কোথায়ও 'পিশিল' বলিয়া জানে। এখন লোকেরা তাহাদের জনপদে যেরূপ জানে তাহাতে অভিনিবেশ পূর্বক বিশেষ জোর দিয়া বলে, 'ইহাই সত্য, অন্যটি ভুল'। ভিক্ষুগণ! এইরূপে জনপদ নিরুক্তিতে অভিনিবেশ ও স্থানীয় সংজ্ঞায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিরূপে জনপদ নিরুক্তিতে... ..আরোপ করা হয় না? ভিক্ষুগণ! বিভিন্ন জনপদে একই জিনিষকে... জানে। এখন এক জনপদের লোক অন্য জনপদে যাইয়া নিজস্ব নিরুক্তির প্রতি আসক্ত না থাকিয়া অন্য জনপদের ভদ্রজনোচিত শব্দ ব্যবহার করে। এইরূপে, ভিক্ষুগণ! জনপদ নিরুক্তিতে আরোপ করা হয় না।"

বিনয় চুল্লবর্গ এবং অরণবিভঙ্গ সুত্তের উদ্ধৃতি হইতে ইহা সুপরিস্ফুট যে বুদ্ধ বৈদিক ভাষা অর্থাৎ প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে ভিক্ষুদের স্বকীয় নিরুক্তির মাধ্যমে বুদ্ধবচন শিক্ষা করিবার পক্ষপাতী ছিলেন, আবার আঞ্চলিক উপভাষার (জনপদ নিরুক্তি) প্রতি অত্যধিক আসক্ত না থাকিয়া অন্য জনপদের ভাষার শব্দভান্ডার প্রয়োজন মত ব্যবহার করিবার পরামর্শ দিয়াছেন যাহাতে বিভিন্ন অঞ্চল, জাতি, গোত্র হইতে আগত ভিক্ষুদের ধর্মালোচনা ও পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের অসুবিধা না হয়, উপরন্তু পরস্পরের বোধগম্য হয়। ইহা হইতে সহজেই অনুমেয় যে বৃদ্ধ নিজেও অঙ্গ-মগধ হইতে কুরু-পাণ্ডাল, শাক্য-মল্ল হইতে বৎস পর্যন্ত মধ্য ভারতের বিভিন্ন জনপদে যখন ধর্মপ্রচার করিতে গিয়াছেন, তখন অধিবাসীদের বোধগম্য ভাষায় ধর্মোপদেশ দিয়াছেন এবং প্রয়োজনমত স্থানীয় শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করিয়াছেন। বৃদ্ধবচনের ভাষা যে প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃত অথবা পরবর্তী পাণিনি পতঞ্জলির লৌকিক সংস্কৃত নহে, বরং ইহা আর্য' ভারতে প্রচলিত জনসাধারণের বোধগম্য সাধারণ (common) মৌখিক ভাষা সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত ভারতবর্ষেও বৈদিক তথা সংস্কৃত সাহিত্য-ভাষার পাশাপাশি ভারতীয় আর্যদের দৈনন্দিন জীবনের ভাববিনিময়ের উপযোগী মৌখিক বা কথ্য ভাষা প্রচলিত ছিল। অধ্যাপক ডঃ সত্যরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এই মত পোষণ করেন।

বৈয়াকরণিকেরা এই মৌখিক ভাষার নাম দিয়াছেন প্রাকৃত এবং আধুনিক পণ্ডিতগণ ইহাকে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা নামে আখ্যাত ও শ্রেণীভুক্ত করিয়াছেন। আধুনিক পণ্ডিতদের এইরূপ শ্রেণীবিন্যাসের কারণ সম্ভবতঃ বুদ্ধ-মহাবীরের সময় হইতে ক্রমাগত ধর্মতত্ত্ব ও দার্শনিক আলোচনার ফলে এই মৌখিক ভাষা গুরুত্ব অর্জন করে এবং ক্রমশঃ সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ভাষায় রূপান্তরিত হইতে থাকে। বৃদ্ধ-মহাবীরের সময়ে (খৃঃ পুঃ ষষ্ঠ শতাব্দী) বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষা থাকা সত্ত্বেও তাহাদের একটি সাধারণ বোধগম্য রূপ (lingua franca) ছিল তাহা সহজেই অনুমেয়। ইহার নিদর্শন আমরা পাই খুঃ পুঃ তৃতীয় শতাব্দীতে প্রচলিত সম্রাট অশোকের শিলা- লিপির ভাষা হইতে। অশোকের শিলালিপি দক্ষিণে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক হইতে উত্তরে নেপাল সীমান্ত ও উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাকিস্তান এবং পূর্বে বিহার হইতে পশ্চিমে গুজরাট, রাজস্থান পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গিয়াছে। এই সকল শিলালিপির ভাষা প্রাকৃত এবং এই ভাষা জনসাধারণের বোধগম্য না হইলে অশোক ঐ সকল স্থানে শিলালিপিগুলি উৎকীর্ণ করিতেন না। আফগানিস্তানের কান্দাহারে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে তিনি প্রাকৃতের পরিবর্তে স্থানীয় অধিবাসীদের বোধগম্য গ্রীক ও আরামাইক ভাষায় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে শিলালিপিগুলিতে ব্রাহ্মী লিপির পরিবর্তে খরোষ্ঠী লিপি ব্যবহার করিয়াছেন। ভারতীয় আর্য ভাষার ক্রম বিবর্তনের ইতিহাসে অশোকের শিলালিপির গুরুত্ব ও মূল্য অপরিসীম।

যদিও বুদ্ধবচনের ভাষার রূপের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ আমাদের হস্তগত হয় নাই, তথাপি আমরা অনুমান করিতে পারি যে বুদ্ধ তদানীন্তন ভারতে প্রচলিত প্রাকৃতের মত মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার অন্তর্ভুক্ত জনসাধারণের বোধগম্য যে মৌখিক ভাষায় দীর্ঘ পাঁয়তাল্লিশ বৎসর ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন, তাহা একদিকে যেমন বুদ্ধবচনকে ভিত্তি করিয়া পণ্ডিত শিষ্যগণ কর্তৃক বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর তাঁহার উপদেশাবলী সূত্রাকারে সংকলন, জীবনী রচনা ও বিনয় নিয়মাবলী সুবিন্যস্তভাবে গ্রথিত করিবার ফলে সাহিত্য-ভাষায় (literary language) উন্নীত হয়। অন্য দিকে বিভিন্ন কুল, গোত্র ও জনপদ হইতে দীক্ষিত ভিক্ষুগণ কর্তৃক বৌদ্ধ সংঘে সমবেতভাবে ধর্মালোচনা, ভাববিনিময় করিবার ফলে সেই ভাষার মধ্যে আঞ্চলিক উপভাষার বৈশিষ্ট্য- মিশ্রিত হইতে থাকে। এইভাবে কালক্রমে বুদ্ধবচনের ভাষা একটি মিশ্র সাহিত্য ভাষায় পরিণত হয় এবং সংগৃহীত বুদ্ধবচন ও অন্যান্য রচনা নিকায়, পিটকাদিতে বিন্যস্ত হইয়া একত্রে বর্তমান ত্রিপিটকের রূপ ধারণ করে। পরবর্তীকালে ত্রিপিটক বা 'পালির' ভাষাই পালি ভাষা নামাঙ্কিত হইয়াছে। ব্যাকরণাদি রচনার ফলে পালিভাষা সংস্কৃতের মত একটি প্রামাণ্য সাহিত্য- ভাষারূপে মর্যাদা লাভ করিয়াছে। ব্রিপিটক ব্যতীত টীকা-গ্রন্হাদি এবং পরবর্তীকালে সিংহল, ব্রহ্মদেশ ও শ্যামদেশে বহু গ্রন্থ পালি ভাষায় রচিত হইয়াছে। মৌখিক ভাষা হইতে সাহিত্যিক ভাষায় উন্নীত হইলেও অন্যান্য প্রাকৃত উপভাষার মত মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার সাধারণ লক্ষণ (general character) পালিতে বর্তমান। পালি ও প্রাকৃতে প্রাচীন সংস্কৃত ব্যাকরণ- গত রূপ অনেক সরলীকৃত হইয়াছে। প্রায় সমস্ত শব্দকে 'অ' কারান্ত শব্দরূপে পরিণত করার ও সমস্ত ধাতুকে আদিগণীয় ধাতুরূপে পরিণত করার প্রবল ঝোঁক দেখা যায়। চতুর্থী বিভক্তি লুপ্ত হইয়া ষষ্ঠী বিভক্তিতে পরিণত হইয়াছে। প্রথমা ও দ্বিতীয়ার বহুবচনের রূপ সমতুল এবং দ্বিবচন লুপ্ত হইয়াছে। আত্মনেপদের ব্যবহার নাই বলিলেই হয়। পালিতে প্রাকৃতের মত ধ্বনিগত পরিবর্তন দেখা যায়। সংস্কৃতের ১৩টি স্বরবর্ণের মধ্যে মাত্র অ, আ, ই, ঈ,উ, উ, এ, ও পালিতে এই আটটি বর্তমান। লুপ্ত স্বরবর্ণগুলির অনুকল্প- রূপে বর্তমান স্বরবর্ণ ব্যবহৃত হইয়াছে। শ, ষ, স অন্য প্রাকৃতের মত (মাগধী ব্যতীত) স-তে পরিবর্তিত হইয়াছে। পদান্ত ব্যঞ্জনবর্ণ লুপ্ত হইয়াছে। হ্রস্বম্বরের পরে দুই এবং দুই-এর বেশী সংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থাকিতে পারে না এবং দীর্ঘস্বরের পরে একটিমাত্র অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থাকিতে পারে। বিভিন্ন উচ্চারণস্থান উদ্ভুত দুইটি সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বন সমী-ভবন প্রাপ্ত হয়, ইত্যাদি।

মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হইলেও পালি বৌদ্ধ থেরবাদ শাস্ত্রের ভাষারূপে অন্য আঞ্চলিক উপভাষা হইতে স্বতন্ত্রভাবে বিকাশ লাভ করিয়া একটি সম্পূর্ণ পৃথক্ মিশ্র সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হইয়াছে। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে এই জাতীয় সাহিত্যভাষা কোন একটি আঞ্চলিক উপভাষা হইতেই উদ্ভুত হয়। ভারতীয় ও ইউরোপীয় বহু পণ্ডিত পালি ভাষার উৎপত্তিস্থল আঞ্চলিক উপভাষা নির্ণয় করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন।এই পণ্ডিতগণ নিজেদের দৃষ্টিকোণ হইতে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করিয়াছেন। 'ওয়েন্টার গার্ড' ও 'কুন'-এর মতে উজ্জয়িনী বা অবন্তী অঞ্চলের ভাষা হইতে পালির উৎপত্তি। কারণ, গিরনারে প্রাপ্ত অশোকের শিলালিপির ভাষার সহিত পালির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। ইহা ছাড়াও অশোকপুত্র মহিন্দ এই অঞ্চলে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন এবং সেইখানেই বড় হইয়াছেন। পরবর্তীকালে তিনি ভিক্ষু হইয়া সিংহলে পালিশাস্ত্র প্রচার করিয়া- ছিলেন। সুতরাং পালি উজ্জয়িনীর ভাষা। ওল্ডেনবার্গ মনে করেন, পালি কলিঙ্গের ভাষা। কারণ উদয়গিরি খণ্ডগিরিতে প্রাপ্ত খারবেলের শিলালিপির ভাষার সহিত পালির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। তিনি আরও মনে করেন, সিংহলে মহিন্দের ধর্মপ্রচার অনৈতিহাসিক। তাঁহার মতে সিংহলের সঙ্গে ভারতের উপকূলভাগে দীর্ঘকাল সমুদ্রপথে যাতায়াত সম্পর্কে'র মাধ্যমেই বৌদ্ধধর্ম এবং ত্রিপিটক ঐ দ্বীপে প্রচারিত হইয়াছিল। ই. মুলারও এই মত পোষণ করেন। লুডার্স'-এর মতে প্রাচীন অর্ধমাগধীই পালির ভিত্তি। পি. ভি. বাপত এই মতের বিরোধিতা করিয়া বলিয়াছেন অর্ধমাগধী প্রাকৃতেরই উন্নত স্তরের ভাষা, পালির নহে। গ্রিয়ার্সন এবং নলিনাক্ষ দত্ত পালিতে পৈশাচী প্রাকৃতের উপাদানের উল্লেখ করিয়াছেন। টেন কোনোর মতে পালি এবং পৈশাচী বিন্ধ্য অঞ্চলের ভাষা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে পালি শব্দরূপ ও ধ্বনি পদ্ধতির সঙ্গে শৌরসেনী প্রাকৃতের সর্বাপেক্ষা বেশী সাদৃশ্য আছে, সুতরাং পালি শূরসেন বা মথুরা অঞ্চলের ভাষা। উত্তর-পশ্চিমা ও অন্য আর্য উপভাষা হইতে প্রাচীন রূপগুলি পালিতে অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। রীজ ডেভিড্ সের মতে কোশলের উপভাষাই পালির ভিত্তি। ম্যাক্স ওয়ালেসার মনে করেন পালি পাটলিপুত্রের ভাষা। আবার অনেক পন্ডিতের মতে সিংহলী ঐতিহ্যে উল্লিখিত প্রাচীন মাগধীই পালি ভাষা। উপরোক্ত আলোচনা হইতে বুঝা যাইতেছে যে পালিভাষার উৎপত্তি স্থল নির্ণয় সম্পর্কে' পণ্ডিতেরা ঐক্যমতে আসিতে পারেন নাই। তাঁহাদের মত আংশিকভাবে সত্য। কারণ বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষার শব্দভাণ্ডার এবং ব্যাকরণগত রূপ পালিতে মিশ্রিত হইয়াছে। পালিতে মাগধী উপভাষার উপাদান, যেমন র এর পরিবর্তে ল এবং প্রথমার এক বচনে 'ও' বিভক্তির পরিবর্তে' 'এ' বিভক্তির ব্যবহার কদাচিৎ দৃষ্ট হয়, যদিও ইহা পালির সাধারণ নিয়ম নহে। আবার শৌরসেনী এবং অন্যান্য উপভাষার প্রথমার একবচনে  'ও' বিভক্তির ব্যবহার পালির ব্যাকরণগত রূপ। মাহারাষ্ট্রীর মত স্বরমধ্যস্থ ক, গ, চ, জ, ত, দ, প, ব, য এর লোপ এবং মহাপ্রাণ বর্ণ খ, ঘ, থ, ধ, ফ, ভ এর পরিবর্তে 'হ' ব্যবহারও পালিতে দৃষ্ট হয় না। শৌরসেনীর মত পালিতে তও থ যথাক্রমে দওধতে পরিবর্তিত হয় না। মাগধী ও উত্তর পশ্চিমা প্রাকৃতের 'শ'-এর ব্যবহারও পালিতে নাই। অর্ধমাগধীর সহিত পালির যেমন সাদৃশ্য আছে, তেমনই বৈসাদৃশ্যও যথেষ্ট বর্তমান। আবার অশোকের শিলালিপির কোন আঞ্চলিক উপভাষার সহিতও পালির অভিন্নতা প্রমাণ করা যায় না। সুতরাং কোন আঞ্চলিক উপভাষা হইতে পালির উৎপত্তি হইয়াছে তাহা বর্তমানে নির্ণয় করা সম্ভব নহে। অশোকের শিলালিপির ভাষা সম্পর্কে এই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য। বেণীমাধব বড়ুয়া অশোকের শিলালিপির প্রাকৃত ভাষাকে পাঁচটি উপভাষায় শ্রেণীভুক্ত করিয়াছেন, যথা গিরণার, শাহবাজগরহী, কলসি, ব্রহ্মগিরি ও ধৌলি। তিনি উদাহরণ উদ্ধৃত করিয়া দেখাইয়াছেন যে কোন শিলালিপির ভাষাই বৈয়াকরণিকদের উল্লিখিত আঞ্চলিক প্রাকৃত উপভাষার সহিত সম্পূর্ণ অভিন্ন নহে। পালির ক্ষেত্রেও বলা যায় যে ইহা জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত বুদ্ধকালীন সাধারণ মৌখিক ভাষা হইতে উদ্ভূত হইয়াছে। কোন বিশেষ আঞ্চলিক উপভাষা ইহার উৎপত্তিস্থল বলিয়া প্রমাণ করিবার মত উপকরণ আমাদের হাতে নাই। যদিও বহু আধুনিক পণ্ডিত মনে করেন যে কোন আঞ্চলিক উপভাষাই পালির ভিত্তি। বেণীমাধব বড়ুয়ার মতে সম্ভবতঃ বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষায় ত্রিপিটকের গ্রন্থাবলীর সংস্করণ ছিল। তবে তাহাদের মধ্যে সংকলনরীতি ও প্রাচীনত্বে পালি সংস্করণই শ্রেষ্ঠ।

পালি ভাষার বিবর্তন ও বিকাশের ধারা পর্যবেক্ষণ করিয়া ইহাকে চারিটি স্তরে বিভক্ত করা যায়, যথা- (১) প্রাচীন গাথার ভাষা। ইহা সম- প্রকৃতির নহে, উপরন্তু বিভিন্ন উপাদানে গঠিত। ইহাতে দুর্বোধ্য অপ্রচলিত প্রাচীন শব্দের অব্যাকরণগত প্রয়োগ দেখা যায়, বৈদিক বিভক্তির প্রয়োগও দেখা যায়। অনেক বৈদিক শব্দ মধ্যভারতীয় আর্য ভাষায় রূপান্তরিত করিয়া প্রযুক্ত হইয়াছে। পালিশাস্ত্রের প্রাচীনতম রচনাগুলি ইহার অন্তর্ভুক্ত। (২) দ্বিতীয় স্তরের ভাষার নিদর্শন দেখা যায় গদ্যে বা গদ্য-পদ্যে রচিত সুত্তগুলিতে, ভাষা সহজ, সরল ও শব্দের প্রয়োগ ব্যাকরণসম্মত। এই ভরের নিদর্শন পাওয়া ত্রিপিটকের গদ্য-সূত্রগুলিতে। ইহাতে প্রাচীন শব্দ- গুলি ক্রমশঃ অন্তর্হিত হইয়াছে। (৩) তৃতীয় স্তরের পালির নিদর্শন পাওয়া যায় মিলিন্দপঞ্জহ ও ত্রিপিটকের গ্রন্থাবলীর অঠকথা বা টীকা গ্রন্থে। এই পর্যায়ের পালির ভিত্তি ত্রিপিটকের গদ্যের ভাষা এবং ইহাতে কৃত্রিমতা ও সাহিত্যিক পাণ্ডিত্য প্রতিভাত। (৪) চতুর্থ স্তরের পালির নিদর্শন পাওয়া যায় খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী ও পরবর্তীকালের কাব্য গ্রন্থাদিতে। এই পর্যায়ে অনেক শতক কাব্য ও বৃহৎ কাব্যগ্রন্থ রচিত হইয়াছে। এইসকল কাব্য অলঙ্কার সৌন্দর্যে অনুপম ও কাব্যকুশলতায় উৎকৃষ্ট। কাব্যগুলি যেমন বিভিন্ন বৈচিত্র্যে পূর্ণ তেমনি রচয়িতাগণ প্রাচীন ও অর্বাচীন সাহিত্য হইতে শব্দ ভাণ্ডার আহরণ করিয়াছেন এবং ভাষায় ও রচনারীতিতে সংস্কৃতের প্রভাব সুস্পষ্ট।

পালির ভাষার উপরোক্ত চারি স্তর বিশ্লেষণ করিয়া অনুমান করা যায় যে বুদ্ধের পরিনির্বাণের অব্যবহিত পরে যখন বুদ্ধশিষ্যগণ গাথা ও প্রাচীনতম 'সুত্তগুলি' রচনা করিতে আরম্ভ করেন তখনও বুদ্ধবচন সংকলন করিবার পক্ষে ভাষা যথোপযোগী সমৃদ্ধ ছিল না। সেইজন্য প্রথম স্তরের পালিতে আঞ্চলিক উপভাষা বা প্রাকৃতের শব্দভাণ্ডার ও রূপ, প্রাচীন দুর্বোধ্য শব্দ এবং শব্দে বৈদিক রূপ ও প্রয়োগ করিতে হইয়াছে। কিন্তু পরবর্তী স্তরগুলিতে বৈদিক ও মাগধীসহ আঞ্চলিক প্রাকৃতের ব্যাকরণগতরূপ ও ধ্বনি পদ্ধতি ক্রমশঃ মুক্ত হইয়া সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে রচিত পালি ব্যাকরণ অনুযায়ী বাক্য রচনা ও মধ্যভারতীয় আর্যভাষায় রূপান্তরিত সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করিয়া পালি সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হইয়াছে। পালি ভাষার বিবর্তনে সংস্কৃতের প্রভাব সুস্পষ্ট।

ত্রিপিটকের অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলির রচনা ও তাহাদের তিনটি পিটকে শ্রেণী- বিভাজন একদিনে হয় নাই, তাহা সম্পূর্ণ হইতে কয়েক শতাব্দী অতিক্রান্ত হইয়াছিল। উরুবিলের বোধিতরুমূলে পরম সত্যজ্ঞান প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব জানিয়া বারণাসীর ঋষিপত্তনের মুগদাবে যেইদিন পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের নিকট সেই তত্ত্ব চতুরার্যসত্য প্রথম প্রকাশ করিলেন সেইদিনই পালিশাস্ত্র রচনার বীজ উপ্ত হইয়াছিল। তারপর দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বৎসর ব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় বহু ধর্মোপদেশ দিয়াছেন, ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করিয়াছেন এবং বিনয় নিয়মাবলী প্রবর্ত'ন করিয়াছেন। বুদ্ধের পরিনির্বাণের অব্যবহিত পরেই প্রধান শিষ্যগণ সেই সকল বুদ্ধবচন সংগ্রহ ও সংকলন করিবার জন্য উদ্যোগী হইলেন। পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে যে সেই উদ্দেশ্যে সংঘনায়ক মহাকাশ্যপ কর্তৃক পাঁচশত অহ'ৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। বিনয় চুল্লবঙ্গের বিবরণ অনুসারে এই সম্মেলনে সমগ্র পাতিমো এবং দীঘনিকায়ের অন্তর্ভুক্ত ব্রহ্মজাল সূত্ত ও সামঞ ঞফল সুত্ত আবৃত্তি করা হইয়াছে। সম্ভবতঃ এই দুইটি সুত্ত উদাহরণ হিসাবেই উল্লিখিত হইয়াছে। সুত্তপিটকের অন্যান্য গ্রন্থ বা সূত্রের সংকলনের সংকলিত হইবার সম্ভাবনা উড়াইয়া দেওয়া যায় না। ইহাতে অভিধম্ম পিটকের কোন উল্লেখ নাই। ত্রিপিটকের গ্রন্থগুলিতে কেবল ধম্ম-বিনয় এই দুই বিভাগের উল্লেখ আছে। মনে হয় সেই সময়ে অভিধম্ম পিটকের কোন গ্রন্হ রচিত হয় নাই। বুদ্ধের পরিনির্বাণের ১০০ বৎসর পরে দশটি বিনয়-নিয়ম বিরোধী বৃজিপুত্রীয় ভিক্ষুদের আচরণ বিচার করিবার জন্য বৈশালীতে দ্বিতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেও ধর্মবিনয় আবার আবৃত্তি ও সংগৃহীত করা হয়। চুল্লবঙ্গের বিবরণে কোন গ্রন্থ বা সূত্রে উল্লেখ না থাকিলেও যে পদ্ধতিতে উপরোক্ত বিনয়-বিরোধী আচরণের বিচার করা হয় তাহাতে মনে হয় মহাবঙ্গে উল্লিখিত সঙ্ঘ পরিচালনার নিয়ম- কানুন প্রচলিত ছিল। দীপবংসের বিবরণ হইতে ত্রিপিটকের গ্রন্থ সম্পর্কে অধিক তথ্য পাওয়া যায়। ইহাতে উল্লিখিত হইয়াছে, দ্বিতীয় সঙ্গীতির পরে থেরবাদ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া মহাসংঘিকগণ ধর্ম' বিনয়ের অনেক পরিবর্তন সাধন করেন। তাঁহারা সুত্ত-বিনয়ের কিছু অংশ বর্জ'ন করিয়া মূলের সমতুল্য অন্য সুত্ত-বিনয় সংকলন করেন এবং পরিবার অর্থোদ্ধার অর্থাৎ টীকা, অভিধর্ম প্রকরণ, পটিসম্ভিদা, 'নিন্দ্ন্দেস' ও জাতকের অংশ বিশেষ বর্জন করিয়া প্রতিরূপ গ্রন্থ সংকলন করেন। এই বিবরণ হইতে আমরা অনুমান করিতে পারি যে ইতিমধ্যে অভিধম্ম পিটকের গ্রন্থগুলির রচনা কার্য আরম্ভ হইয়াছিল এবং খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে অভিধম্মের সর্বশেষ গ্রন্থ কথাবন্ধু মোগলিপুত্ত তিস্স কর্তৃক সংকলিত হওয়ায় অভিধম্ম পিটকসহ ত্রিপিটক সংকলন সম্পূর্ণ হয়। তবে এখনো পর্যন্ত 'ত্রিপিটক' রূপে পালিশাস্ত্রের শ্রেণী বিভাজন হয় নাই বলিয়া মনে হয় এবং খৃঃ পুঃ প্রথম শতাব্দীতে বট্টগামনী কর্তৃক ত্রিপিটক লিপিবন্ধ করিবার পূর্ব পর্যন্ত পালিশাস্ত্রের সংশোধন পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হইয়াছে এমন কি সুত্তবিভঙ্গ ও নিন্দেসের মত টীকা গ্রন্হও অনুপ্রবিষ্ট হইয়াছে। বিষয়বস্তু ও বিভিন্ন সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করিয়া বিমলা চরণ লাহা পালি ত্রিপিটকের গ্রহগুলির নিম্নলিখিত কালক্রম (chronology) নির্দেশ করিয়াছেন:

১। বর্তমান ত্রিপিটকের সকল গ্রন্থের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে পুনঃ পুনঃ উল্লিখিত বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কীয় সাধারণ উক্তি বা বিবরণ।

২।দুই বা ততোধিক গ্রন্থে প্রাপ্ত একই কাহিনী।

৩। শীলসমূহ, প্রস্তাবনা ব্যতীত পারায়নবঙ্গ ও অট্ঠকবঙ্গের কবিতাগুলি, শিক্ষাপদসমূহ।

৪। দীঘনিকায়ের প্রথম খন্ড, মজঝিমনিকায়, সংযুত্তনিকায়, অঙ্গুত্তর- নিকায় এবং পাতিমোখের প্রাচীন ১৫২টি নিয়ম।

৫। দীঘনিকায়ের ২য় ও ৩য় খন্ড, থের-থেরীগাথা, জাতক, সুত্তবিভঙ্গ, পটিসম্ভিদামঙ্গ, পুষ্পলপঞঞত্তি, বিভঙ্গ।

৬। বিনয় মহাবঙ্গ ও চুল্লবঙ্গ, ২২৭ টি নিয়ম সমন্বিত সম্পূর্ণ পাতিমোক্খ, বিমানবন্ধু, পেতবন্ধু, ধম্মপদ এবং কথাবন্ধু।

৭। চুল্লনিন্দেস, মহানিন্দেস, উদান, ইতিবৃত্তক, সুত্তনিপাত, ধাতুকথা, যমক ও পট্ঠান।

৮। বুদ্ধবংস, চরিয়াপিটক ও অপদান।

৯। পরিবারপাঠ।

১০। খুন্দক পাঠ।

অভিধম্ম পিটকের অস্তিত্ব সম্পর্কে আধুনিক পণ্ডিতগণ সন্দেহ পোষণ করিলেও খৃঃ পুঃ তৃতীয় শতাব্দীতে অন্ততঃ বিনয়পিটক ও সুত্তপিটক যে সংকলিত হইয়াছিল সেই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। ইহার প্রধান সাক্ষ্য সম্রাট অশোকের শিলালিপি। পালি শাস্ত্রে যে নৈতিক চরিত্রনীতি, সহনশীলতা, পরোপকারিতা ও আত্ম পর্যবেক্ষণের রীতি প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা অশোকের শিলালিপিতেও ধ্বনিত হইয়াছে এবং উভয়ের মধ্যে প্রকাশ ভঙ্গিমায়ও সাদৃশ্য দেখা যায়। বেণীমাধব বড়ুয়া, হলুশ (Hultzsch) প্রভৃতি পণ্ডিতগণ পালি শাস্ত্র হইতে উদ্ধৃতি দিয়া শিলালিপির সহিত সাদৃশ্য দেখাইয়াছেন। ভারু শিলালিপিতে অশোক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উদ্দেশ্য করিয়া বলিয়াছেন, "যে কে চি ভংতে ভগবতা বুধেন ভাসিতে সবে সে সুভাসিতে বা", তাহা অঙ্গুত্তরনিকায়ে উল্লিখিত "যং কিঞ্চি ভগবতা সম্মা সমুদ্ধেন ভাসিতং সম্বং তং সুভাসিতং”-এর প্রতিধ্বনি। একই শিলালিপিতে বুদ্ধ, ধর্ম', সঙ্ঘের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়া সন্ধর্মে'র দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য যে সাতটি ধর্মপর্যায় ভিক্ষুদের শ্রবণ ও মননের জন্য নির্দেশ দিয়াছেন সেইগুলি পালি শাস্ত্রে নিহিত আছে।

ভারহৃত ও সাঞ্চী স্তূপে খৃষ্টপূর্ব-দ্বিতীয়/প্রথম শতাব্দীতে খোদিত শিলালিপি ও ভাস্কর্য হইতেও পালি শাস্ত্রের বিষয়বস্তু ও শ্রেণীবিভাজনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐ সমন্ড ভাস্কর্যে বৃদ্ধজীবনের যে সমস্ত দৃশ্য চিত্রিত হইয়াছে তাহাতে প্রমাণিত হয় যে সেই সময়ে বুদ্ধের জীবন কাহিনী রচনা যথেষ্ট পরিণতি লাভ করিয়াছিল এবং সেইগুলি আমরা পালি সুত্তগুলিতে, বিশেষতঃ নিদানকথা, ললিতবিস্তর, মহাবস্তু প্রভৃতি গ্রন্থগুলিতে দেখিতে পাই এবং শিলালিপিসহ যে সমস্ত জাতক কাহিনী চিত্রিত হইয়াছে, সেই- গুলিও পালি জাতকগ্রন্থে পাওয়া যায়। অধিকন্তু উৎসর্গিত স্তূপ শিলা- লিপিতে ভিক্ষুদের উপাধিরূপে 'ভাণক' অর্থাৎ আবৃত্তিকার, 'সুতংতিক' অর্থাৎ সূত্র আবৃত্তিকার, 'পচনেকায়িক' অর্থাৎ পঞ্চনিকায়জ্ঞ, 'পেটকিন' অর্থাৎ পিটকবিশারদ, 'ধম্মকথিক' অর্থাৎ 'ধর্ম' প্রচারক' শব্দগুলি উল্লিখিত আছে। উপরোক্ত বিবরণ হইতে সহজেই অনুমান করা যায় যে খৃষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে অর্থাৎ অশোকের সম সময়ে একটি বৌদ্ধ শাস্ত্র সংগ্রহ বিদ্যমান ছিল যাহা বিভিন্ন পিটকে ও পঞ্চ নিকায়ে বিভক্ত ছিল। এইরূপ বিভাগ আমরা বর্তমান ত্রিপিটকে পাই।

'ত্রিপিটক' (পিটকত্তয়ং) শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খৃষ্টীয় প্রথম/ দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত মিলিন্দ পঞ্জহ (মিলিন্দ প্রশ্ন) গ্রন্থে। এই গ্রন্থে যে সকল ত্রিপিটকের ও অন্যান্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, তাহাতে মনে হয় ঐ সকল গ্রন্থ বুদ্ধের পরিনির্বাণের দুইশত বৎসরের মধ্যে রচিত হইয়াছিল এবং ত্রিপিটক বহির্ভূত গ্রন্থাবলী, দীপবংস, মহাবংস ও ত্রিপিটকের গ্রন্থাবলীর টীকা মন্হগুলির (অঠকথা) বিবরণ হইতেও ইহা প্রমাণিত হয়। মোট কথা খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে যে পালি ত্রিপিটকের অস্তিত্ব ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

অধিকন্তু, বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশ হইতেও পালি শাস্ত্রের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয়। ঐ সংস্কৃত সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত গ্রহগুলি কিছু বিশুদ্ধ সংস্কৃতে ও কিছু মিশ্র সংস্কৃতে রচিত। মধ্য এশিয়ায় প্রাপ্ত পুঁথি, চৈনিক ও তিবতী অনুবাদ এবং কাশ্মীর ও নেপালে প্রাপ্ত পুঁথি হইতে প্রমাণিত হয় যে মূল সর্বান্তিবাদীদের একটি সম্পূর্ণ 'সংস্কৃতপিটক' বিদ্যমান ছিল। সংস্কৃত পিটক ও পালিপিটকের মধ্যে শব্দপ্রয়োগে ও বিষয় বিন্যাসে কিছু ব্যতিক্রম থাকিলেও উভয়ের মধ্যে মূল অংশে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে এবং তাহাতে মনে হয় তাহাদের পটভূমিকায় একই ঐতিহ্য বর্তমান ছিল। তবে পালি সংস্করণই সর্বতোভাবে প্রাচীনতর ও অবিসংবাদিতভাবে উত্তম। পালি ত্রিপিটক খৃঃ পুঃ প্রথম শতাব্দীতে সিংহলে প্রথম লিপিবদ্ধ করা হইলেও ইহাতে সম্রাট অশোক এবং সিংহল সম্পর্কে কোন উল্লেখ নাই। ইহাতেও প্রমাণিত হয় যে ত্রিপিটকের মূল অংশ অশোকের পূর্বে ভারতবর্ষে সংকলিত হইয়াছিল এবং সিংহলী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ সেই পালি শাস্ত্র পরম বিশ্বস্ততা সহকারে দুই হাজার বৎসর ব্যাপী রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে ত্রিপিটক ও ত্রিপিটক বহির্ভূত মহাবলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হইল।

গ্রন্থনির্দেশ

১। Winternitz, History of Indian Literature, II. P.8.

২। Majjhima Nikāya, I. P.133; Milinda Panha, P. 345.

৩। Cullavagga, V, 4; VI, 13; IX, 5

81 Winternitz, ঐ, P. 11.

৫! B. C. Law, History of Pali Literature, Vol. I. Intro- duction.

৬। Dr. Satya Ranjan Banerji, A Handbook of Sanskrit

Philology, P, LXXXI.

৭। W. Geiger, Pali Literature and Language, PP, 2ff.

৮। B. M. Barna, Aśoka and His Inscriptions, P. 7.

৯। A. C. Woolner, Introduction to Prakrit, P. 73.

১০। Anguttaranikāya, IV, P, 163, 

সংগৃহীতঃ  বৌদ্ধ সাহিত্য - বিনয়েন্দ্রনাথ চৌধুরী

অ- বর্ণের অভিধান - ২

  অকতাগস [ অকত+আগস] পাপ না করিয়া। =>  আগু, আগস । অকতাভিনিবেস (বিণ) অমনোযোগী। => কতাভিনিবেস । অকত্তব্ব (বিণ) অকর্তব্য, অনুচিত, যাহা কর...