
প্রাক্-বুদ্ধ ভারতের ইতিহাস বৈদিক এবং বেদোত্তর সাহিত্যের ভিত্তিতে অনুমান নির্ভরশীল হইয়া রচিত হইয়াছে। বৌদ্ধ সাহিত্য হইতেই প্রথম ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহের অনেকটা নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। বৌদ্ধ সাহিত্য শুধু বুদ্ধকালীন ভারতের নহে প্রাক্-বুদ্ধ ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক অবস্থার উপর যথেষ্ট আলোকপাত করে। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ সাহিত্যের সূচনা হয় গৌতম বুদ্ধের ধর্মচক্র প্রবর্তনের সময় হইতে। বুদ্ধের পরিনির্বাণের অনতিকাল পরেই তদীয় শিষ্যগণ বুদ্ধবাণী সংগ্রহ করিয়া সংরক্ষণের জন্য সচেষ্ট হন। পণ্ডিতেরা মনে করেন, গৌতম বুদ্ধ আনুমানিক ৪৮৩ খৃষ্ট পূর্বাব্দে পরিনির্বাণ লাভ করিয়াছেন। বৌদ্ধ ঐতিহ্যমতে তিনি ৮০ বৎসর জীবিত ছিলেন। এই হিসাবে তাঁহার জন্ম হয় খৃঃপুঃ ৫৬৩ অব্দে। উনত্রিশ বৎসর বয়সে সমস্ত রাজৈশ্বর্ষ' ও ভোগ- বিলাস ত্যাগ করিয়া সিদ্ধার্থ গৌতম সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেন এবং উরুবিলে (বুদ্ধ গয়া) বোধিতর মূলে ছয় বৎসর তপস্যান্তে পরম সত্যজ্ঞান উপলব্ধি করিয়া ও মানুষের দুঃখমুক্তির উপায় উদ্ভাবন করিয়া জগতে বুদ্ধ রূপে খ্যাত হইলেন। তারপর দীর্ঘ ৪৫ বৎসর উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করিয়া ধর্ম প্রচার করিলেন। কালক্রমে বুদ্ধের ধর্ম' সমগ্র ভারতে এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এত বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল যে এই ধর্ম পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলির মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছে।
সম্ভবতঃ বুদ্ধের জীবদ্দশায় ত্রিপিটকের কোন গ্রন্থ রচিত হয় নাই। পালি ত্রিপিটকের অধিকাংশ সূত্র এবং ধর্মোপদেশ বুদ্ধের মুখনিঃসৃত এবং বিনয়পিটকের নিয়মাবলী বুদ্ধনির্দেশিত বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে এবং কখন, কোথায় ও কোন প্রসঙ্গে তিনি সেই উপদেশ দান করিয়াছেন অথবা উদান আবৃত্তি করিয়াছেন তাহাও বিকৃত হইয়াছে। এই সমস্ত ধর্মদেশনার কতটা যথার্থ বুদ্ধের মুখনিঃসৃত তাহা আজ জানিবার উপায় নাই, যেহেতু তাহার কোন লিখিত প্রমাণ নাই। তবে প্রতীত্যসমুৎপাদ, চতুরার্যসত্য, আর্য' অষ্টাঙ্গিকমার্গ, নির্বাণ কিংবা পরিনির্বাণের পূর্বে তিনি ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে যে সকল উপদেশ দিয়াছেন, অথবা ধম্মপদ, উদান, ইতিবৃত্তক প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁহার সংক্ষিপ্ত ভাষণ 'বুদ্ধবচন' বলিয়া উল্লিখিত, সেইগুলি যে বুদ্ধের নিজস্ব কথা তাহা বিশ্বাসযোগ্য। এইগুলি বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য, তিব্বতী ও চীনা অনুবাদেও পাওয়া যায়। অবশ্য বুদ্ধের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে কেহ কেহ যে ধর্মদেশনা করিয়াছেন তাহার নিদর্শন নিকায়গুলিতে পাওয়া যায়। গৌতমবুদ্ধ শুধু ধর্মোপদেশ দান ও ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন নাই, তিনি ভিক্ষুসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করিয়া তাঁহার প্রবর্তিত শিক্ষাপদ ও প্রাতিমোক্ষ নিয়মাবলীর মাধ্যমে শিষ্যদের পবিত্র-জীবন যাপন ও ধর্ম'সাধনার দ্বারা চরম লক্ষ্য নির্বাণোপলব্ধির জন্য পরিচালিত করিয়াছেন।
বৌদ্ধদের প্রাচীনতম সাহিত্য ধর্মদেশনা, কথোপকথন, গীতিকবিতা, আখ্যান ও সঙ্গের নিয়মাবলীর সংগ্রহ লইয়া রচিত। পালি ত্রিপিটক এই সকল সংগ্রহের বিরাট-সংগ্রহ-সংকলন। ইহা সহজেই অনুমেয় যে ত্রিপিটক সংকলন সম্পূর্ণ হইবার বহু পূর্ব হইতে ইহার অর্ন্তভুক্ত গ্রন্থগুলির রচনাকার্য' আরম্ভ হইয়াছিল এবং ইহার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে রচিত হইয়াছিল। বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে এই সংকলনের প্রথম পর্যায় সমাপ্ত হইয়াছিল বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিন মাস পরে প্রধান শিষ্যদের সহযোগিতায় স্থবির কাশ্যপের (পালি কস্সপ) সভাপতিত্বে রাজগৃহে অনুষ্ঠিত প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতিতে। এই সম্মেলনে স্থবির আনন্দ সমগ্র ধর্ম এবং স্থবির উপালি সমগ্র বিনয় আবৃত্তি করিয়াছিলেন। এই সংগ্রহে শুধু দীর্ঘনিকায়ের অর্ন্তভুক্ত ব্রহ্মজাল সুত্ত ও সামঞঞফল সূত্ত এবং বিনয়ের পাতিমোস্থের নিয়মগুলির অংশবিশেষ উল্লিখিত হইয়াছে। 'ধর্মবিনয়ের' ঠিক কতটা অংশ এই সম্মেলনে সংগৃহীত হইয়াছিল তাহা জানিবার উপায় নাই। এত অল্প সময়ে বুদ্ধের দীর্ঘ' প্রচার জীবনের সমগ্র 'বুদ্ধবচন' সংগ্রহ করিতে না পারাই স্বাভাবিক।
বিনয় চুল্লবর্গ এবং সিংহলী কাহিনী অনুসারে বুদ্ধের পরিনির্বাণের একশত বৎসর পরে বৃজিপুত্রীয় (বজিপুত্তক) ভিক্ষুদের দশটি বিনয় বিরোধী আচরণ বন্ধ করিবার উদ্দেশ্যে বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি সাতশত অহ'ৎ স্থবিরের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। এই সম্মেলনে প্রথমে বৃজিপুত্রীয়দের দশ প্রকার আচরণ বিনয় বিরোধী বলিয়া ঘোষণা করা হয় এবং তাহাদের নিগৃহীত করা হয়। ইহার পর 'ধর্মবিনয়' প্রথম সঙ্গীতির মত পুনরাবৃত্তিও সংগৃহীত হয়। দ্বিতীয় সঙ্গীতির ঐতিহাসিকত্ব সম্পর্কে আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু বুদ্ধের পরিনির্বাণের দ্বিতীয় শতাব্দীতে যে বৌদ্ধ সঙ্ঘে বিভেদ দেখা দেয় এবং ইহা কতকগুলি শাখায় বিভক্ত হইয়া পড়ে সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সিংহলী ঐতিহ্যমতে বৃজিপুত্রীয় ভিক্ষুগণ সম্মেলনে প্রত্যাখ্যাত হইয়া নিজেরা অন্য একটি সম্মেলন আহ্বান করেন এবং বিপুল সংখ্যক ভিক্ষু (দীপবংস মতে দ্বাদশ সহস্র) এই সম্মেলনে যোগদান করেন। সেই জন্য ইহা মহাসঙ্গীতি নামে খ্যাত এবং যাঁহারা মহাসঙ্গীতিতে যোগদান করিয়াছিলেন তাঁহারা মহাসাংঘিক নামে পরিচিত হইলেন। আর প্রাচীনপন্থী ভিক্ষুগণ থেরবাদী বা স্থবিরবাদী নামে অভিহিত হইলেন। এই ঘটনার ঐতিহাসিকত্ব অস্বীকার করা যায় না, কারণ পরবর্তীকালে এই দুই শাখা হইতে উদ্ভূত মহীশাসক, সর্বাস্তিবাদ, বহুশ্রুতীয়, ধর্ম'গুপ্ত, পূর্বশৈল, অপরশৈল প্রভৃতি বহু শাখায় বা সম্প্রদায়ে বৌদ্ধসংঘ বিভক্ত হইয়াছিল। দীপবংস (৫ম অধ্যায়) মতে মহাসাংঘিক ও অন্য সম্প্রদায়ের ভিক্ষুগণ জাতক, পটিসম্ভিদামগ্গ প্রভৃতি গ্রহগুলির পরিবর্তন সাধন করেন এবং বুদ্ধবচনের জটিল অংশগুলি বাদ দিয়া তাঁহারা নিজস্ব রচনা সংযোজন করেন। দীপবংসের বিবরণ হইতে প্রতীয়মনে হয়, সেই সময়ে উপরোক্ত গ্রন্থগুলি রচিত হইয়াছিল। পর্যন্ত অভিধর্ম পিটকের অস্তিত্ব ছিল বলিয়া মনে হয় না। তখনও দীপবংস, মহাবংস ও সমস্তপাসাদিকার বিবরণ হইতে জানা যায় যে মৌর্য' সম্রাট অশোকের (খৃঃ পুঃ ৩য় শতাব্দী) রাজত্বকালে মোগলিপুত্ত তিস্সের সভাপতিত্বে পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। এই অধিবেশনে প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতিতে আলোচিত ও গৃহীত 'ধর্ম'বিনয়' পুনরায় আলোচিত ও গৃহীত হয়। তৃতীয় পিটক অভিধম্মের অস্তিত্বের কথা এই সম্মেলনের বিবরণী হইতে জানা যায়। কথিত আছে, অনেক অবৌদ্ধ তীর্থিক লাভ-সৎকারের জন্য বৌদ্ধ সংঘে প্রবেশ করেন। তাঁহাদের সঙ্গে প্রাচীনপন্থী ভিক্ষুগণ পাক্ষিক উপোসথ পালন করিতে অস্বীকার করেন এবং তাহাতে বহুদিন পাটলিপুত্রের অশোকারাম বিহারে উপোসথ পালন স্থগিত ছিল। সম্রাট এই ঘটনা জানিতে পারিয়া একজন মন্ত্রীকে তথায় প্রেরণ করিলেন যাহাতে তিনি ভিক্ষুদিগকে উপোসথ পালনে রাজী করাইতে পারেন। কিন্তু মন্ত্রীর অনুরোধেও ভিক্ষুগণ রাজী না হওয়ায় তিনি তাঁহাদিগকে হত্যা করিতে আরম্ভ করেন। ইহাতে ক্ষুব্ধ হইয়া অশোকের ভ্রাতা তিস্স স্থবির মন্ত্রীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া মন্ত্রী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়েন এবং সমস্ত বিষয় সম্রাটের গোচরে আনিলেন। ইহাতে সম্রাট অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং মন্ত্রীর হঠকারিতার জন্য নিজেকে দায়ী করেন। এইজন্য তিনি তদানীন্তন সংঘনায়ক মোগলিপুত্ত তিস্সের নিকট যাইয়া তাঁহার কৃত পাপকর্মে'র শাস্তি কি হইতে পারে তাহা জিজ্ঞাসা করিলেন। তদুত্তরে সংঘনায়ক বলিলেন যে সম্রাট সম্পূর্ণ নির্দোষ, কারণ উক্ত পাপকার্য তাঁহার ইচ্ছাকৃত নহে। মোগলিপুত্ত তিস্সের পরামর্শে সম্রাট সকল ভিক্ষুকে পরীক্ষা করাইলেন এবং যাঁহারা বিভজ্জবাদী নহেন অর্থাৎ বিশুদ্ধ থেরবাদী নহেন তাঁহাদের শ্বেতবস্ত্র পরিধান করাইয়া সংঘ হইতে বহিষ্কৃত করিলেন।
সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় তিস্স পাটলিপুত্রে এক সম্মেলনের আহ্বান করেন যাহা সিংহলী ঐতিহ্যে তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি নামে খ্যাত। দশমাস ব্যাপী এই সম্মেলনে প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতিতে আলোচিত ও সংগৃহীত বুদ্ধের ধর্মবিনয় পুনরায় আলোচিত ও সংগৃহীত হয়। এই সময়ে মোঙ্গলিপুত্ত তিস্স অভিধম্ম পিটকের অন্তর্ভুক্তি 'কথাবন্ধু' গ্রন্থটি রচনা করেন। এই বিবরণ হইতে বুঝা যায় যে এই সময়ে অভিধম্ম পিটক সংকলন কার্য সম্পূর্ণ না হইলেও অনেকদূর অগ্রসর হইয়াছিল। বহু পন্ডিত উপরোক্ত কাহিনী ও তৃতীয় সঙ্গীতির ঐতিহাসিকত্বে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু ইহা সত্য যে দ্বিতীয় সঙ্গীতির পর বৌদ্ধ সংঘে যে বিভেদ শুরু হইয়াছিল তদ্ধেতু দুইশত বৎসর ব্যবধানে বৌদ্ধগণ বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হইয়াছিল এবং মতবাদ ও আচার আচরণে তাঁহাদের মধ্যে যথেষ্ট বৈষম্য দেখা দিয়াছিল। সম্রাটের আনুকুল্যে যখন বিভজ্জবাদীগণ অনেক সুযোগ সুবিধা লাভ করিয়াছিল তখন অন্য সম্প্রদায়ের বৌদ্ধগণ থেরবাদ সংঘে অনুপ্রবেশ করিয়াছিল। ইহাতে প্রাচীনপন্থী থেরবাদীগণ বুদ্ধের মূল ধর্মতত্ত্ব ও বিনয়বিধি অটুট রাখিবার জন্য সচেষ্ট হইয়া সম্মেলনের আয়োজন করিয়াছিলেন। অধিবেশন হওয়া অস্বাভাবিক নহে। সুতরাং ইহা থেরবাদ সংঘের কথাবন্ধুর বিষয়বস্তু হইতেও অনুমান করা যায় যে তৃতীয় সঙ্গীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল থেরবাদী দৃষ্টি- ভঙ্গী হইতে অথেরবাদী শাখাগুলির মতাদর্শ বিশ্লেষণ করিয়া খন্ডন করা। ভিক্ষুদের শ্বেতবস্ত্র পরিধান করাইয়া বহিষ্কারের ব্যবস্থা হইয়াছিল। সিংহলী ঐতিহ্য অনুসারে এই সময় হইতে ধর্ম' ও বিনয় দুই ভাগে বিভক্ত বুদ্ধবচন তিন ভাগে অর্থাৎ ত্রিপিটকে বিভক্ত করা হয়। একই ঐতিহ্য মতে মোগলিপুত্ত তিস্স তৃতীয় সঙ্গীতির শেষে বিভিন্ন দেশে ধর্ম'-প্রচারের জন্য বিশিষ্ট ভিক্ষুদের প্রেরণ করেন। তদীয় শিষ্য অশোকপুত্র (মতান্তরে ভ্রাতা) মহিন্দথের পালি শাস্ত্রসহ সিংহল (লংকাদ্বীপ) গমন করিয়া তথায় বৌদ্ধ সংঘ প্রতিষ্ঠিত করেন। তৃতীয় সঙ্গীতিতে সংকলিত পালি ত্রিপিটক খৃঃ পুঃ প্রথম শতাব্দীতে সিংহলরাজ বট্টগামনীর তত্ত্বাবধানে প্রথম লিপিবদ্ধ করা হয়। ইহাই বর্তমান পালি ত্রিপিটক।'
'পিটক' (বিকল্পে 'পেটক') শব্দের অর্থ পাত্র বা ঝুড়ি। অন্যমতে পিটক শব্দের অর্থ ঝুড়িতে বা আধারে রক্ষিত পাণ্ডুলিপি (পুঁথি)। পিটক শব্দ ঐতিহ্য (tradition) অর্থেও প্রযোজ্য। প্রাচীন ভারতে গুরুশিষ্য পরম্পরায় মৌখিক ঐতিহ্যে শাস্ত্রাদি সংরক্ষণের রীতি প্রচলিত ছিল। লিপিবদ্ধ করিবার রীতি প্রচলিত হইবার পর এই শাস্ত্র পৃথক্ পৃথক আধারে রক্ষিত হইত। বুদ্ধবচন সংরক্ষণের জন্য শ্রেণীবিন্যস্ত রচনা সংগ্রহ অর্থে পিটক শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। বর্তমান পালি ত্রিপিটক তিনটি পিটকের সমষ্টি, যথা-১। বিনয় পিটক-বৌদ্ধ সংঘের বিবিধ কর্মে'র এবং ভিক্ষ, ভিক্ষুণীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণের নিয়মাবলী সম্পর্কিত রচনা সংগ্রহ; ২। সুত্তপিটক-বুদ্ধের ধর্মদেশনা, ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যামূলক গদ্যে পদ্যে রচিত সূত্র সংগ্রহ এবং ৩। অভিধম্মপিটক -উচ্চতর ধর্মের তত্ত্ব বা ধর্মের উচ্চতর সূক্ষ্যতত্ত্বালোচনা বিষয়ক রচনা সংগ্রহ। সুত্তপিটকে আলোচিত ধর্ম বা চিত্তবিষয়ক শিক্ষার বিশদভাবে বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যাই অভিধম্ম পিটকের প্রতিপাদ্য বিষয়।
ত্রিপিটকের বিভিন্ন গ্রন্থে। আমরা বুদ্ধবচনের নয়টি অঙ্গের (নবঙ্গ সসাসন) উল্লেখ দেখিতে পাই। নয়টি অঙ্গ হইল-১। 'সুত্ত' (সূত্র) অর্থাৎ গদ্যে ধর্মোপদেশ; ২। 'গেয়া' অর্থাৎ গদ্য ও পদ্যে মিশ্রিত ধর্মো- পদেশ; ৩। 'বেয্যাকরণ' (ব্যাকরণ) অর্থাৎ ব্যাখ্যা বা টীকা। বৌদ্ধ সংস্কৃত ও পালি নিদান কথায় ভবিষ্যদ্বাণী অর্থে বেয্যাকরণ শব্দটি প্রযুক্ত হইয়াছে। ৪। 'গাথা' অর্থাৎ ছন্দোবদ্ধ রচনা বা কবিতা; ৫। 'উদান' অর্থাৎ সারবান সংক্ষিপ্ত আবেগময় উক্তি; ৬। ইতিবৃত্তক অর্থাৎ 'ইহা ভগবান বলিয়াছেন' এইরূপ উক্তি আরম্ভ করিয়া ক্ষুদ্র ভাষণ; ৭। 'জাতক' অর্থাৎ বুদ্ধের অতীত জীবনের কাহিনী; ৮। 'অব্ভূতধৰ্ম্ম' (অদ্ভুত ধর্ম') অর্থাৎ অলৌকিক ক্রিয়ার বিবরণ; ৯। 'বেদল্ল' অর্থাৎ প্রশ্নোত্তর বা কথোপকথনে ধর্মোপদেশ। বুদ্ধবচন বা শান্তার শাসনের এই 'নবাঙ্গ' কিন্তু ত্রিপিটকের বিভিন্ন বিভাগ নহে কিংবা ত্রিপিটকের বিশেষ বিশেষ গ্রহকেও বুঝায় না। ইহার দ্বারা পালি শাস্ত্রের বিভিন্ন রচনা পদ্ধতির শ্রেণীবিন্যাস করা হইয়াছে। বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যেও নবাঙ্গের সমতুল বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই নয় প্রকার অঙ্গ বা রচনা পদ্ধতির উল্লেখ হইতে প্রমাণিত হয় বর্তমান আকারে যখন ত্রিপিটক সংকলিত হয় তাহার পূর্বে এই নয় প্রকার রচনার অস্তিত্ব ছিল। অধিকন্তু, সেই সময়ে 'নবাঙ্গ' ছাড়াও বহু, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থ, বিনয় নিয়মাবলী, সূত্র, কথিকা, নীতিকথামূলক গাথা এবং অট্ঠকবঙ্গের মত সূত্র সংগ্রহ বুদ্ধবচনরূপে ত্রিপিটকে পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ এই সমস্ত সূত্র ক'ঠস্থ করিতেন। বারে বারে আবৃত্তি করিতেন এবং ব্যাখ্যা করিতেন, যাহাতে সকলেই বুদ্ধের ধর্ম-বিনয় যথার্থরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন। এইভাবে বুদ্ধবচন দীর্ঘকাল প্রচলিত থাকিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল। ভিক্ষুদের মধ্যে বহু 'সুত্তস্তিক' অর্থাৎ সূত্রের আবৃত্তিকারী, 'ধম্মকথিক' অর্থাৎ ধর্ম'তত্ত্বের প্রচারক এবং 'বিনয়ধর' অর্থাৎ বিনয় নিয়মাবলী সম্পর্কে' বিশারদ ছিলেন বলিয়া বিনয় পিটকে উল্লেখ আছে।
বর্ষাবাসের সময় যখন বহু পণ্ডিত ভিক্ষু বিহারে সমবেত জীবন যাপন করিতেন তখন অন্য ভিক্ষুগণ ধর্ম বিনয়ের জটিল অংশগুলি তাঁহাদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিবার সুযোগ পাইতেন। সম্ভবতঃ বিহারের কোন পণ্ডিত ভিক্ষু অথবা ভিক্ষুসংঘ কোন বিষয় ধর্ম' বা বিনয়ের অঙ্গীভূত বলিয়া ঘোষণা কবিবার পূর্বে উক্ত বিষয় শাস্তার (বুদ্ধের ধর্মে'র বা বিনয়ের অনুরূপ কিনা তাহা পরীক্ষা করিয়া লইতেন। বিষয়ের যথার্থতা অনুসন্ধান করিবার মত কোন বিনয়ে পারদর্শী পণ্ডিত ভিক্ষু বর্তমান ছিলেন। এইরূপ পণ্ডিত ভিক্ষুদের সম্পর্কে' বলা হইয়াছে, ধম্মধরা বিনয়ধরা মাতিকাধরা' অর্থাৎ বহুশ্রুত, শাস্ত্র ইহাতে মনে হয় সেই সময় প্রামাণ্য গ্রন্হ কিংবা ধর্ম' ত্রিপিটকের অনেক স্কুলে 'বহুস্তা আগতাগমা বিশারদ, ধর্ম বিশারদ, বিনয় বিশারদ ও মাতৃকা বিশারদ। ধর্ম ও বিনয় নিয়মাবলী সম্পর্কিত সংক্ষিপ্তরূপকে মাতিকা বলা হয়। ইহাতে মনে হয় ধর্ম সম্পর্কিত সুত্তপিটক এবং বিনয় নিয়মাবলী সম্পর্কিত বিনয় পিটক অভিধর্ম পিটকের পূর্বে সংকলিত হইয়াছে। আবার মাতৃকা পদ্ধতি অভিধর্ম পিটকের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে কথাবন্ধু অভিধর্ম পিটকের গ্রন্থ- গুলির মধ্যে সর্বশেষে রচিত এবং ইহাই একমাত্র গ্রন্থ যাহার রচয়িতার নাম সিংহলী ঐতিহ্য হইতে জানা গিয়াছে। সম্ভবতঃ খৃঃ পুঃ ৩য় শতাব্দীর পূর্বে অভিধম্ম পিটকের গ্রন্থগুলির রচনা আরম্ভ হইয়াছিল। ৪
যে বুদ্ধবচনকে ভিত্তি করিয়া ত্রিপিটক সংকলিত হইয়াছিল সেই বুদ্ধবচন তথা ত্রিপিটকের ভাষার প্রশ্নও তাহার সঙ্গে জড়িত। ত্রিপিটকের ভাষা পালি ভাষা নামে খ্যাত। পরবর্তীকালে সিংহল, ব্রহ্মদেশ, শ্যাম প্রভৃতি দেশে ত্রিপিটক বহির্ভূত বহু পালি গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। ভাষারূপে পালি শব্দের ব্যবহার খুব সাম্প্রতিক কালের। আধুনিক ইউরোপীয় পন্ডিতগণ অথবা সিংহলী বৌদ্ধগণ পালিভাষা নামকরণ করিয়াছেন বলিয়া মনে হয়।"
আচার্য বুদ্ধঘোষের সময়ে (খৃষ্টীয় ৫ম শতাব্দী) 'পালি' শব্দটি ত্রিপিটকের মূল গ্রন্থ বুঝাইতে প্রযুক্ত হইত। চুল্লবর্গে উল্লিখিত আছে: "পালিমত্তং ইধানীতং ন অঠকথা এব" অর্থাৎ পালিই শুধু এইখানে (সিংহল) আনীত হইয়াছে, অর্থকথা (টীকা) নহে। বুদ্ধঘোষ নিজেও তাঁহার অর্থ- কথাগুলিতে পালি শব্দটি একই অর্থে প্রয়োগ করিয়াছেন। অর্থকথায় পালি শব্দের প্রতিশব্দরূপে বৃদ্ধবচন, ত্রিপিটক, তন্তি, পরিয়ত্তি প্রভৃতি শব্দগুলি পাওয়া যায়। আবার সিংহলী ঐতিহ্যে ত্রিপিটকের ভাষাকে অর্থাৎ পালির ভাষাকে বলা হইয়াছে মাগধী নিরুক্তি অর্থাৎ মগধের ভাষা। বুদ্ধঘোষও বৃদ্ধবচনের ভাষাকে মাগধী নিরুক্তি বলিয়াছেন। যদিও বুদ্ধ তাঁহার প্রচার জীবনের অধিকাংশ সময় মগধ অঞ্চলের মধ্যে অতিবাহিত করিয়াছিলেন তথাপি ইহা বলা যথেষ্ট নহে যে বুদ্ধ একমাত্র মাগধী ভাষাতেই ধর্ম প্রচার করিয়াছেন। ইহা সিংহলী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উদ্ভাবন মাত্র। বুদ্ধ কোশল অঞ্চলেও অধিকাংশ সময় অতিবাহিত ও ধর্ম প্রচার করিয়াছেন এবং অবন্তী, শূরসেন, বৎস, কুরু, পাণ্ডাল, শাক্য, মল্ল প্রভৃতি মধ্য ভারতের (পালি মজঝিমদেস) বিভিন্ন মহাজনপদে, বিভিন্ন নগরে, গ্রামে, গঞ্জে ধর্ম প্রচার করিয়াছেন। সেই সকল জনপদেও আঞ্চলিক উপভাষা প্রচলিত ছিল। এখন প্রশ্ন হইতেছে, বুদ্ধ কি কোন নির্দিষ্ট একটি ভাষাতে ধর্মপ্রচার করিতেন কিংবা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে ধর্মপ্রচার করিতেন? ইহা নিশ্চিত যে বুদ্ধ যখন যে অঞ্চলে গিয়াছেন তথাকার স্থানীয় অধিবাসিদের বোধগম্য ভাষায় ধর্মোপদেশ দিয়াছেন। আমাদের সৌভাগ্যবশতঃ বিনয় চুল্লবঙ্গে (পৃঃ ১৩৯) এমন একটি ঘটনার বিবরণ উল্লিখিত হইয়াছে যাহা হইতে বুদ্ধবচনের ভাষার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ঘটনাটি এইরূপ: সেই সময়ে যমেল ও তেকুল নামে ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব দুই ভ্রাতা ভিক্ষু ভগবান বুদ্ধের নিকট আসিয়া বলিলেন, 'ভদন্ত! এখন বিভিন্ন কুল, বিভিন্ন গোত্র ও বিভিন্ন জাতি হইতে প্রব্রজিত ভিক্ষুগণ স্বকীয় নিরুক্তি (পালি-সকায় নিরুত্তি) দ্বারা প্রচার করিয়া বুদ্ধবচনকে দূষিত (বিকৃত) করিতেছেন, ভদন্ত! এখন হইতে আমরা ছন্দসে বুদ্ধবচন ভাষান্তরিত (অনূদিত) করিব।' বুদ্ধ তাঁহাদিগকে তিরস্কার করিয়া বলিলেন, 'হে মুঢ়গণ! তোমরা কী বলিতেছ, এখন আমরা বুদ্ধবচন ছন্দসে ভাষান্তরিত করিব! ইহাতে তথাগতের প্রতি অপ্রসন্নগণ প্রসন্ন হইবেন না এবং প্রসন্নদেরও প্রসন্নতা বর্ধিত হইবে না'। এই প্রসঙ্গে তিনি অনুশাসন দিলেন, 'ভিক্ষুগণ! তোমরা বুদ্ধবচনকে ছন্দসে ভাষান্তরিত করিবে না; করিলে দুষ্কৃত আপত্তি (দোষ) হইবে। ভিক্ষুগণ! আমি অনুমোদন করিতেছি তোমরা 'সকায় নিরুত্তি'তে বুদ্ধবচন শিক্ষা কর।'
আচার্য' বুদ্ধঘোষ ছন্দস শব্দের অর্থ করিয়াছেন 'বৈদিক সংস্কৃত' (পালি- বেদং বিয় সক্কত ভাষায় বাচনামঙ্গং) এবং 'সকানিরুত্তি' শব্দের অর্থ করিয়াছেন বুদ্ধ ব্যবহৃত মাগধী ভাষা (পালি-এখ সকা নিরুত্তি নাম সম্মা সম্বন্ধেন বৃত্তপকারো মাগধকো বোহারো)। ইহা উল্লেখযোগ্য যে 'সংস্কৃত' শব্দটি ভাষারূপে বুদ্ধ ও পাণিনির পরবর্তীকালে প্রচলিত হইয়াছে। পাণিনির মতে ভাষা দুই প্রকার (১) বৈদিক এবং লৌকিক (প্রচলিত) এবং ছন্দস হইতেছে সংস্কৃতের লৌকিক রূপ হইতে ভিন্ন বৈদিক ভাষা। সম্ভবতঃ বুদ্ধও ছন্দস বলিতে তদানীন্তনকালে অপ্রচলিত প্রাচীন বৈদিক ভাষাকে বুঝাইয়াছেন। 'সকা নিরুত্তি' শব্দে বুদ্ধের প্রচার মাধ্যমরূপে মাগধী ভাষা বলিয়া বুদ্ধঘোষ যে অভিমত দিয়াছেন তাহা মানিয়া লওয়া কঠিন। বুদ্ধের মত বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন চিন্তানায়ক যে তাঁহার ধর্মপ্রচারের মাধ্যমরূপে মাগধী উপভাষাই একমাত্র নির্ভুল এবং অন্য উপভাষাগুলি ত্রুটিপূর্ণ বলিয়া মত পোষণ করিবেন তাহা মানিয়া লওয়া কঠিন। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধঘোষ আমাদের বিভ্রান্ত করিয়াছেন। চুল্লবর্গ বিবরণ হইতে প্রতীয়মান হয় যে 'সকানিরুত্তি' শব্দের অর্থ স্বকীয় ভাষা বা স্থানীয় আঞ্চলিক উপভাষা (local dialect) অর্থ হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। পরবর্তীকালের ইতিহাসও ইহার সাক্ষ্য দেয়। বুদ্ধের জীবদ্দশায় ও পরিনির্বাণের পর বৌদ্ধধর্ম' সমগ্র উত্তর ভারতে এবং দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশে বিস্তৃত হইয়াছিল। দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির পর যখন বৌদ্ধ সংঘ নানা শাখায় বিভক্ত হইয়াছিল তখন বুদ্ধবচনকে ভিত্তি করিয়া তাঁহারা নিজেদের পৃথক পৃথক শাস্ত্র সংকলন করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে হৈমবত, ধর্ম'গুপ্ত, কাশ্যপীয়দের শাস্ত্র কোন কোন ভাষায় রচিত হইয়াছিল তাহা আমাদের সঠিক জানা নাই। সেইগুলি কেবল চীনা অনুবাদেই পাওয়া গিয়াছে। চীনা অনুবাদ ও মধ্য এশিয়ায় প্রাপ্ত প্রাকৃত ধর্ম'পদের ভাষা বিশ্লেষণ করিয়া মনে হয় ধর্ম'গুপ্তদের শাস্ত্র উত্তর- পশ্চিম ভারতে প্রচলিত প্রাকৃত ভাষায় লিখিত হইয়াছিল। ঐ অঞ্চলে প্রাপ্ত অশোক শিলালিপির ভাষার সহিত যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। মহাসংঘিক ও সম্মিতীয়দের শাস্ত্র প্রাকৃতবহুল মিশ্র সংস্কৃতে রচিত হইয়াছিল। সর্বান্তিবাদ ও মূল সবাস্তিবাদীদের শাস্ত্র আদিতে মিশ্র সংস্কৃত ও পরে বিশুদ্ধ সংস্কৃতে রচিত হইয়াছিল। এই সম্প্রদায়ের সংকলিত সম্পূর্ণ সংস্কৃত পিটক পাওয়া গিয়াছে যাহার সহিত পালি ত্রিপিটকের বিষয়গত ও বিন্যাসগত সাদৃশ্য আছে। পালি ত্রিপিটক একান্তভাবে থেরবাদী বা বিভজ্জবাদীদের অবদান। শাস্ত্র রচনার জন্য বিভিন্ন শাখা তাহাদের প্রধান কেন্দ্রগুলির স্থানীয় উপভাষা এবং ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভব পণ্ডিত ভিক্ষুগণ সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়।
বিভিন্ন অঞ্চল, কুল, গোত্র, জাতি হইতে আগত ভিক্ষুগণ তাঁহাদের স্বকীয় ভাষা অর্থাৎ আঞ্চলিক উপভাষায় বুদ্ধবচন শিক্ষা করিবার জন্য অনুমতি দান করিলেও তাহার ফলে যাহাতে সংঘমধ্যে ভিক্ষুদের পারস্পরিক শাস্ত্রালোচনা তথা ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যার বিঘ্ন না হয় তজ্জন্য বুদ্ধ সচেতন ছিলেন বলিয়া মনে হয়। এই বিঘ্নের কারণ ভিক্ষুদের নিজস্ব জনপদের ভাষার প্রতি অত্যাসক্তি। এই অত্যাসক্তি হইতে যাহাতে ভিক্ষুগণ মুক্ত থাকিতে পারেন সেই জন্য তিনি তাঁহাদের সতর্ক করিয়া দেন। মঝিমনিকায়ের 'অরণবিভঙ্গ' সুত্তের নিম্নোদ্ধৃত অনুচ্ছেদ এই সম্পর্কে' আলোকপাত করে:
"ভিক্ষুগণ! জনপদ নিরুক্তিতে (স্থানীয় উপভাষা) অভিনিবেশ করা ও স্থানীয় সংজ্ঞায় (শব্দ বা পদ) অধিক গুরুত্ব আরোপ করা উচিত নহে, ইহা কথিত হইয়াছে। ইহা কেন উক্ত হইয়াছে? কিরূপে জনপদ নিরুক্তিতে অভিনিবেশ ও স্থানীয় সংজ্ঞায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়? ভিক্ষুগণ! বিভিন্ন জনপদের লোকেরা একই জিনিষকে কোথায়ও 'পাতি', কোথায়ও 'পাত্র', কোথায়ও 'বিস্থ', কোথায়ও 'শরাব', কোথায়ও 'ধারোপ', কোথায়ও 'পোণ', আবার কোথায়ও 'পিশিল' বলিয়া জানে। এখন লোকেরা তাহাদের জনপদে যেরূপ জানে তাহাতে অভিনিবেশ পূর্বক বিশেষ জোর দিয়া বলে, 'ইহাই সত্য, অন্যটি ভুল'। ভিক্ষুগণ! এইরূপে জনপদ নিরুক্তিতে অভিনিবেশ ও স্থানীয় সংজ্ঞায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিরূপে জনপদ নিরুক্তিতে... ..আরোপ করা হয় না? ভিক্ষুগণ! বিভিন্ন জনপদে একই জিনিষকে... জানে। এখন এক জনপদের লোক অন্য জনপদে যাইয়া নিজস্ব নিরুক্তির প্রতি আসক্ত না থাকিয়া অন্য জনপদের ভদ্রজনোচিত শব্দ ব্যবহার করে। এইরূপে, ভিক্ষুগণ! জনপদ নিরুক্তিতে আরোপ করা হয় না।"
বিনয় চুল্লবর্গ এবং অরণবিভঙ্গ সুত্তের উদ্ধৃতি হইতে ইহা সুপরিস্ফুট যে বুদ্ধ বৈদিক ভাষা অর্থাৎ প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে ভিক্ষুদের স্বকীয় নিরুক্তির মাধ্যমে বুদ্ধবচন শিক্ষা করিবার পক্ষপাতী ছিলেন, আবার আঞ্চলিক উপভাষার (জনপদ নিরুক্তি) প্রতি অত্যধিক আসক্ত না থাকিয়া অন্য জনপদের ভাষার শব্দভান্ডার প্রয়োজন মত ব্যবহার করিবার পরামর্শ দিয়াছেন যাহাতে বিভিন্ন অঞ্চল, জাতি, গোত্র হইতে আগত ভিক্ষুদের ধর্মালোচনা ও পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের অসুবিধা না হয়, উপরন্তু পরস্পরের বোধগম্য হয়। ইহা হইতে সহজেই অনুমেয় যে বৃদ্ধ নিজেও অঙ্গ-মগধ হইতে কুরু-পাণ্ডাল, শাক্য-মল্ল হইতে বৎস পর্যন্ত মধ্য ভারতের বিভিন্ন জনপদে যখন ধর্মপ্রচার করিতে গিয়াছেন, তখন অধিবাসীদের বোধগম্য ভাষায় ধর্মোপদেশ দিয়াছেন এবং প্রয়োজনমত স্থানীয় শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করিয়াছেন। বৃদ্ধবচনের ভাষা যে প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃত অথবা পরবর্তী পাণিনি পতঞ্জলির লৌকিক সংস্কৃত নহে, বরং ইহা আর্য' ভারতে প্রচলিত জনসাধারণের বোধগম্য সাধারণ (common) মৌখিক ভাষা সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত ভারতবর্ষেও বৈদিক তথা সংস্কৃত সাহিত্য-ভাষার পাশাপাশি ভারতীয় আর্যদের দৈনন্দিন জীবনের ভাববিনিময়ের উপযোগী মৌখিক বা কথ্য ভাষা প্রচলিত ছিল। অধ্যাপক ডঃ সত্যরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এই মত পোষণ করেন।
বৈয়াকরণিকেরা এই মৌখিক ভাষার নাম দিয়াছেন প্রাকৃত এবং আধুনিক পণ্ডিতগণ ইহাকে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা নামে আখ্যাত ও শ্রেণীভুক্ত করিয়াছেন। আধুনিক পণ্ডিতদের এইরূপ শ্রেণীবিন্যাসের কারণ সম্ভবতঃ বুদ্ধ-মহাবীরের সময় হইতে ক্রমাগত ধর্মতত্ত্ব ও দার্শনিক আলোচনার ফলে এই মৌখিক ভাষা গুরুত্ব অর্জন করে এবং ক্রমশঃ সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ভাষায় রূপান্তরিত হইতে থাকে। বৃদ্ধ-মহাবীরের সময়ে (খৃঃ পুঃ ষষ্ঠ শতাব্দী) বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষা থাকা সত্ত্বেও তাহাদের একটি সাধারণ বোধগম্য রূপ (lingua franca) ছিল তাহা সহজেই অনুমেয়। ইহার নিদর্শন আমরা পাই খুঃ পুঃ তৃতীয় শতাব্দীতে প্রচলিত সম্রাট অশোকের শিলা- লিপির ভাষা হইতে। অশোকের শিলালিপি দক্ষিণে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক হইতে উত্তরে নেপাল সীমান্ত ও উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাকিস্তান এবং পূর্বে বিহার হইতে পশ্চিমে গুজরাট, রাজস্থান পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গিয়াছে। এই সকল শিলালিপির ভাষা প্রাকৃত এবং এই ভাষা জনসাধারণের বোধগম্য না হইলে অশোক ঐ সকল স্থানে শিলালিপিগুলি উৎকীর্ণ করিতেন না। আফগানিস্তানের কান্দাহারে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে তিনি প্রাকৃতের পরিবর্তে স্থানীয় অধিবাসীদের বোধগম্য গ্রীক ও আরামাইক ভাষায় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে শিলালিপিগুলিতে ব্রাহ্মী লিপির পরিবর্তে খরোষ্ঠী লিপি ব্যবহার করিয়াছেন। ভারতীয় আর্য ভাষার ক্রম বিবর্তনের ইতিহাসে অশোকের শিলালিপির গুরুত্ব ও মূল্য অপরিসীম।
যদিও বুদ্ধবচনের ভাষার রূপের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ আমাদের হস্তগত হয় নাই, তথাপি আমরা অনুমান করিতে পারি যে বুদ্ধ তদানীন্তন ভারতে প্রচলিত প্রাকৃতের মত মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার অন্তর্ভুক্ত জনসাধারণের বোধগম্য যে মৌখিক ভাষায় দীর্ঘ পাঁয়তাল্লিশ বৎসর ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন, তাহা একদিকে যেমন বুদ্ধবচনকে ভিত্তি করিয়া পণ্ডিত শিষ্যগণ কর্তৃক বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর তাঁহার উপদেশাবলী সূত্রাকারে সংকলন, জীবনী রচনা ও বিনয় নিয়মাবলী সুবিন্যস্তভাবে গ্রথিত করিবার ফলে সাহিত্য-ভাষায় (literary language) উন্নীত হয়। অন্য দিকে বিভিন্ন কুল, গোত্র ও জনপদ হইতে দীক্ষিত ভিক্ষুগণ কর্তৃক বৌদ্ধ সংঘে সমবেতভাবে ধর্মালোচনা, ভাববিনিময় করিবার ফলে সেই ভাষার মধ্যে আঞ্চলিক উপভাষার বৈশিষ্ট্য- মিশ্রিত হইতে থাকে। এইভাবে কালক্রমে বুদ্ধবচনের ভাষা একটি মিশ্র সাহিত্য ভাষায় পরিণত হয় এবং সংগৃহীত বুদ্ধবচন ও অন্যান্য রচনা নিকায়, পিটকাদিতে বিন্যস্ত হইয়া একত্রে বর্তমান ত্রিপিটকের রূপ ধারণ করে। পরবর্তীকালে ত্রিপিটক বা 'পালির' ভাষাই পালি ভাষা নামাঙ্কিত হইয়াছে। ব্যাকরণাদি রচনার ফলে পালিভাষা সংস্কৃতের মত একটি প্রামাণ্য সাহিত্য- ভাষারূপে মর্যাদা লাভ করিয়াছে। ব্রিপিটক ব্যতীত টীকা-গ্রন্হাদি এবং পরবর্তীকালে সিংহল, ব্রহ্মদেশ ও শ্যামদেশে বহু গ্রন্থ পালি ভাষায় রচিত হইয়াছে। মৌখিক ভাষা হইতে সাহিত্যিক ভাষায় উন্নীত হইলেও অন্যান্য প্রাকৃত উপভাষার মত মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার সাধারণ লক্ষণ (general character) পালিতে বর্তমান। পালি ও প্রাকৃতে প্রাচীন সংস্কৃত ব্যাকরণ- গত রূপ অনেক সরলীকৃত হইয়াছে। প্রায় সমস্ত শব্দকে 'অ' কারান্ত শব্দরূপে পরিণত করার ও সমস্ত ধাতুকে আদিগণীয় ধাতুরূপে পরিণত করার প্রবল ঝোঁক দেখা যায়। চতুর্থী বিভক্তি লুপ্ত হইয়া ষষ্ঠী বিভক্তিতে পরিণত হইয়াছে। প্রথমা ও দ্বিতীয়ার বহুবচনের রূপ সমতুল এবং দ্বিবচন লুপ্ত হইয়াছে। আত্মনেপদের ব্যবহার নাই বলিলেই হয়। পালিতে প্রাকৃতের মত ধ্বনিগত পরিবর্তন দেখা যায়। সংস্কৃতের ১৩টি স্বরবর্ণের মধ্যে মাত্র অ, আ, ই, ঈ,উ, উ, এ, ও পালিতে এই আটটি বর্তমান। লুপ্ত স্বরবর্ণগুলির অনুকল্প- রূপে বর্তমান স্বরবর্ণ ব্যবহৃত হইয়াছে। শ, ষ, স অন্য প্রাকৃতের মত (মাগধী ব্যতীত) স-তে পরিবর্তিত হইয়াছে। পদান্ত ব্যঞ্জনবর্ণ লুপ্ত হইয়াছে। হ্রস্বম্বরের পরে দুই এবং দুই-এর বেশী সংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থাকিতে পারে না এবং দীর্ঘস্বরের পরে একটিমাত্র অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থাকিতে পারে। বিভিন্ন উচ্চারণস্থান উদ্ভুত দুইটি সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বন সমী-ভবন প্রাপ্ত হয়, ইত্যাদি।
মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হইলেও পালি বৌদ্ধ থেরবাদ শাস্ত্রের ভাষারূপে অন্য আঞ্চলিক উপভাষা হইতে স্বতন্ত্রভাবে বিকাশ লাভ করিয়া একটি সম্পূর্ণ পৃথক্ মিশ্র সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হইয়াছে। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে এই জাতীয় সাহিত্যভাষা কোন একটি আঞ্চলিক উপভাষা হইতেই উদ্ভুত হয়। ভারতীয় ও ইউরোপীয় বহু পণ্ডিত পালি ভাষার উৎপত্তিস্থল আঞ্চলিক উপভাষা নির্ণয় করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন।এই পণ্ডিতগণ নিজেদের দৃষ্টিকোণ হইতে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করিয়াছেন। 'ওয়েন্টার গার্ড' ও 'কুন'-এর মতে উজ্জয়িনী বা অবন্তী অঞ্চলের ভাষা হইতে পালির উৎপত্তি। কারণ, গিরনারে প্রাপ্ত অশোকের শিলালিপির ভাষার সহিত পালির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। ইহা ছাড়াও অশোকপুত্র মহিন্দ এই অঞ্চলে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন এবং সেইখানেই বড় হইয়াছেন। পরবর্তীকালে তিনি ভিক্ষু হইয়া সিংহলে পালিশাস্ত্র প্রচার করিয়া- ছিলেন। সুতরাং পালি উজ্জয়িনীর ভাষা। ওল্ডেনবার্গ মনে করেন, পালি কলিঙ্গের ভাষা। কারণ উদয়গিরি খণ্ডগিরিতে প্রাপ্ত খারবেলের শিলালিপির ভাষার সহিত পালির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। তিনি আরও মনে করেন, সিংহলে মহিন্দের ধর্মপ্রচার অনৈতিহাসিক। তাঁহার মতে সিংহলের সঙ্গে ভারতের উপকূলভাগে দীর্ঘকাল সমুদ্রপথে যাতায়াত সম্পর্কে'র মাধ্যমেই বৌদ্ধধর্ম এবং ত্রিপিটক ঐ দ্বীপে প্রচারিত হইয়াছিল। ই. মুলারও এই মত পোষণ করেন। লুডার্স'-এর মতে প্রাচীন অর্ধমাগধীই পালির ভিত্তি। পি. ভি. বাপত এই মতের বিরোধিতা করিয়া বলিয়াছেন অর্ধমাগধী প্রাকৃতেরই উন্নত স্তরের ভাষা, পালির নহে। গ্রিয়ার্সন এবং নলিনাক্ষ দত্ত পালিতে পৈশাচী প্রাকৃতের উপাদানের উল্লেখ করিয়াছেন। টেন কোনোর মতে পালি এবং পৈশাচী বিন্ধ্য অঞ্চলের ভাষা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে পালি শব্দরূপ ও ধ্বনি পদ্ধতির সঙ্গে শৌরসেনী প্রাকৃতের সর্বাপেক্ষা বেশী সাদৃশ্য আছে, সুতরাং পালি শূরসেন বা মথুরা অঞ্চলের ভাষা। উত্তর-পশ্চিমা ও অন্য আর্য উপভাষা হইতে প্রাচীন রূপগুলি পালিতে অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। রীজ ডেভিড্ সের মতে কোশলের উপভাষাই পালির ভিত্তি। ম্যাক্স ওয়ালেসার মনে করেন পালি পাটলিপুত্রের ভাষা। আবার অনেক পন্ডিতের মতে সিংহলী ঐতিহ্যে উল্লিখিত প্রাচীন মাগধীই পালি ভাষা। উপরোক্ত আলোচনা হইতে বুঝা যাইতেছে যে পালিভাষার উৎপত্তি স্থল নির্ণয় সম্পর্কে' পণ্ডিতেরা ঐক্যমতে আসিতে পারেন নাই। তাঁহাদের মত আংশিকভাবে সত্য। কারণ বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষার শব্দভাণ্ডার এবং ব্যাকরণগত রূপ পালিতে মিশ্রিত হইয়াছে। পালিতে মাগধী উপভাষার উপাদান, যেমন র এর পরিবর্তে ল এবং প্রথমার এক বচনে 'ও' বিভক্তির পরিবর্তে' 'এ' বিভক্তির ব্যবহার কদাচিৎ দৃষ্ট হয়, যদিও ইহা পালির সাধারণ নিয়ম নহে। আবার শৌরসেনী এবং অন্যান্য উপভাষার প্রথমার একবচনে 'ও' বিভক্তির ব্যবহার পালির ব্যাকরণগত রূপ। মাহারাষ্ট্রীর মত স্বরমধ্যস্থ ক, গ, চ, জ, ত, দ, প, ব, য এর লোপ এবং মহাপ্রাণ বর্ণ খ, ঘ, থ, ধ, ফ, ভ এর পরিবর্তে 'হ' ব্যবহারও পালিতে দৃষ্ট হয় না। শৌরসেনীর মত পালিতে তও থ যথাক্রমে দওধতে পরিবর্তিত হয় না। মাগধী ও উত্তর পশ্চিমা প্রাকৃতের 'শ'-এর ব্যবহারও পালিতে নাই। অর্ধমাগধীর সহিত পালির যেমন সাদৃশ্য আছে, তেমনই বৈসাদৃশ্যও যথেষ্ট বর্তমান। আবার অশোকের শিলালিপির কোন আঞ্চলিক উপভাষার সহিতও পালির অভিন্নতা প্রমাণ করা যায় না। সুতরাং কোন আঞ্চলিক উপভাষা হইতে পালির উৎপত্তি হইয়াছে তাহা বর্তমানে নির্ণয় করা সম্ভব নহে। অশোকের শিলালিপির ভাষা সম্পর্কে এই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য। বেণীমাধব বড়ুয়া অশোকের শিলালিপির প্রাকৃত ভাষাকে পাঁচটি উপভাষায় শ্রেণীভুক্ত করিয়াছেন, যথা গিরণার, শাহবাজগরহী, কলসি, ব্রহ্মগিরি ও ধৌলি। তিনি উদাহরণ উদ্ধৃত করিয়া দেখাইয়াছেন যে কোন শিলালিপির ভাষাই বৈয়াকরণিকদের উল্লিখিত আঞ্চলিক প্রাকৃত উপভাষার সহিত সম্পূর্ণ অভিন্ন নহে। পালির ক্ষেত্রেও বলা যায় যে ইহা জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত বুদ্ধকালীন সাধারণ মৌখিক ভাষা হইতে উদ্ভূত হইয়াছে। কোন বিশেষ আঞ্চলিক উপভাষা ইহার উৎপত্তিস্থল বলিয়া প্রমাণ করিবার মত উপকরণ আমাদের হাতে নাই। যদিও বহু আধুনিক পণ্ডিত মনে করেন যে কোন আঞ্চলিক উপভাষাই পালির ভিত্তি। বেণীমাধব বড়ুয়ার মতে সম্ভবতঃ বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষায় ত্রিপিটকের গ্রন্থাবলীর সংস্করণ ছিল। তবে তাহাদের মধ্যে সংকলনরীতি ও প্রাচীনত্বে পালি সংস্করণই শ্রেষ্ঠ।
পালি ভাষার বিবর্তন ও বিকাশের ধারা পর্যবেক্ষণ করিয়া ইহাকে চারিটি স্তরে বিভক্ত করা যায়, যথা- (১) প্রাচীন গাথার ভাষা। ইহা সম- প্রকৃতির নহে, উপরন্তু বিভিন্ন উপাদানে গঠিত। ইহাতে দুর্বোধ্য অপ্রচলিত প্রাচীন শব্দের অব্যাকরণগত প্রয়োগ দেখা যায়, বৈদিক বিভক্তির প্রয়োগও দেখা যায়। অনেক বৈদিক শব্দ মধ্যভারতীয় আর্য ভাষায় রূপান্তরিত করিয়া প্রযুক্ত হইয়াছে। পালিশাস্ত্রের প্রাচীনতম রচনাগুলি ইহার অন্তর্ভুক্ত। (২) দ্বিতীয় স্তরের ভাষার নিদর্শন দেখা যায় গদ্যে বা গদ্য-পদ্যে রচিত সুত্তগুলিতে, ভাষা সহজ, সরল ও শব্দের প্রয়োগ ব্যাকরণসম্মত। এই ভরের নিদর্শন পাওয়া ত্রিপিটকের গদ্য-সূত্রগুলিতে। ইহাতে প্রাচীন শব্দ- গুলি ক্রমশঃ অন্তর্হিত হইয়াছে। (৩) তৃতীয় স্তরের পালির নিদর্শন পাওয়া যায় মিলিন্দপঞ্জহ ও ত্রিপিটকের গ্রন্থাবলীর অঠকথা বা টীকা গ্রন্থে। এই পর্যায়ের পালির ভিত্তি ত্রিপিটকের গদ্যের ভাষা এবং ইহাতে কৃত্রিমতা ও সাহিত্যিক পাণ্ডিত্য প্রতিভাত। (৪) চতুর্থ স্তরের পালির নিদর্শন পাওয়া যায় খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী ও পরবর্তীকালের কাব্য গ্রন্থাদিতে। এই পর্যায়ে অনেক শতক কাব্য ও বৃহৎ কাব্যগ্রন্থ রচিত হইয়াছে। এইসকল কাব্য অলঙ্কার সৌন্দর্যে অনুপম ও কাব্যকুশলতায় উৎকৃষ্ট। কাব্যগুলি যেমন বিভিন্ন বৈচিত্র্যে পূর্ণ তেমনি রচয়িতাগণ প্রাচীন ও অর্বাচীন সাহিত্য হইতে শব্দ ভাণ্ডার আহরণ করিয়াছেন এবং ভাষায় ও রচনারীতিতে সংস্কৃতের প্রভাব সুস্পষ্ট।
পালির ভাষার উপরোক্ত চারি স্তর বিশ্লেষণ করিয়া অনুমান করা যায় যে বুদ্ধের পরিনির্বাণের অব্যবহিত পরে যখন বুদ্ধশিষ্যগণ গাথা ও প্রাচীনতম 'সুত্তগুলি' রচনা করিতে আরম্ভ করেন তখনও বুদ্ধবচন সংকলন করিবার পক্ষে ভাষা যথোপযোগী সমৃদ্ধ ছিল না। সেইজন্য প্রথম স্তরের পালিতে আঞ্চলিক উপভাষা বা প্রাকৃতের শব্দভাণ্ডার ও রূপ, প্রাচীন দুর্বোধ্য শব্দ এবং শব্দে বৈদিক রূপ ও প্রয়োগ করিতে হইয়াছে। কিন্তু পরবর্তী স্তরগুলিতে বৈদিক ও মাগধীসহ আঞ্চলিক প্রাকৃতের ব্যাকরণগতরূপ ও ধ্বনি পদ্ধতি ক্রমশঃ মুক্ত হইয়া সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে রচিত পালি ব্যাকরণ অনুযায়ী বাক্য রচনা ও মধ্যভারতীয় আর্যভাষায় রূপান্তরিত সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করিয়া পালি সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হইয়াছে। পালি ভাষার বিবর্তনে সংস্কৃতের প্রভাব সুস্পষ্ট।
ত্রিপিটকের অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলির রচনা ও তাহাদের তিনটি পিটকে শ্রেণী- বিভাজন একদিনে হয় নাই, তাহা সম্পূর্ণ হইতে কয়েক শতাব্দী অতিক্রান্ত হইয়াছিল। উরুবিলের বোধিতরুমূলে পরম সত্যজ্ঞান প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব জানিয়া বারণাসীর ঋষিপত্তনের মুগদাবে যেইদিন পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের নিকট সেই তত্ত্ব চতুরার্যসত্য প্রথম প্রকাশ করিলেন সেইদিনই পালিশাস্ত্র রচনার বীজ উপ্ত হইয়াছিল। তারপর দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বৎসর ব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় বহু ধর্মোপদেশ দিয়াছেন, ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করিয়াছেন এবং বিনয় নিয়মাবলী প্রবর্ত'ন করিয়াছেন। বুদ্ধের পরিনির্বাণের অব্যবহিত পরেই প্রধান শিষ্যগণ সেই সকল বুদ্ধবচন সংগ্রহ ও সংকলন করিবার জন্য উদ্যোগী হইলেন। পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে যে সেই উদ্দেশ্যে সংঘনায়ক মহাকাশ্যপ কর্তৃক পাঁচশত অহ'ৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। বিনয় চুল্লবঙ্গের বিবরণ অনুসারে এই সম্মেলনে সমগ্র পাতিমো এবং দীঘনিকায়ের অন্তর্ভুক্ত ব্রহ্মজাল সূত্ত ও সামঞ ঞফল সুত্ত আবৃত্তি করা হইয়াছে। সম্ভবতঃ এই দুইটি সুত্ত উদাহরণ হিসাবেই উল্লিখিত হইয়াছে। সুত্তপিটকের অন্যান্য গ্রন্থ বা সূত্রের সংকলনের সংকলিত হইবার সম্ভাবনা উড়াইয়া দেওয়া যায় না। ইহাতে অভিধম্ম পিটকের কোন উল্লেখ নাই। ত্রিপিটকের গ্রন্থগুলিতে কেবল ধম্ম-বিনয় এই দুই বিভাগের উল্লেখ আছে। মনে হয় সেই সময়ে অভিধম্ম পিটকের কোন গ্রন্হ রচিত হয় নাই। বুদ্ধের পরিনির্বাণের ১০০ বৎসর পরে দশটি বিনয়-নিয়ম বিরোধী বৃজিপুত্রীয় ভিক্ষুদের আচরণ বিচার করিবার জন্য বৈশালীতে দ্বিতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেও ধর্মবিনয় আবার আবৃত্তি ও সংগৃহীত করা হয়। চুল্লবঙ্গের বিবরণে কোন গ্রন্থ বা সূত্রে উল্লেখ না থাকিলেও যে পদ্ধতিতে উপরোক্ত বিনয়-বিরোধী আচরণের বিচার করা হয় তাহাতে মনে হয় মহাবঙ্গে উল্লিখিত সঙ্ঘ পরিচালনার নিয়ম- কানুন প্রচলিত ছিল। দীপবংসের বিবরণ হইতে ত্রিপিটকের গ্রন্থ সম্পর্কে অধিক তথ্য পাওয়া যায়। ইহাতে উল্লিখিত হইয়াছে, দ্বিতীয় সঙ্গীতির পরে থেরবাদ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া মহাসংঘিকগণ ধর্ম' বিনয়ের অনেক পরিবর্তন সাধন করেন। তাঁহারা সুত্ত-বিনয়ের কিছু অংশ বর্জ'ন করিয়া মূলের সমতুল্য অন্য সুত্ত-বিনয় সংকলন করেন এবং পরিবার অর্থোদ্ধার অর্থাৎ টীকা, অভিধর্ম প্রকরণ, পটিসম্ভিদা, 'নিন্দ্ন্দেস' ও জাতকের অংশ বিশেষ বর্জন করিয়া প্রতিরূপ গ্রন্থ সংকলন করেন। এই বিবরণ হইতে আমরা অনুমান করিতে পারি যে ইতিমধ্যে অভিধম্ম পিটকের গ্রন্থগুলির রচনা কার্য আরম্ভ হইয়াছিল এবং খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে অভিধম্মের সর্বশেষ গ্রন্থ কথাবন্ধু মোগলিপুত্ত তিস্স কর্তৃক সংকলিত হওয়ায় অভিধম্ম পিটকসহ ত্রিপিটক সংকলন সম্পূর্ণ হয়। তবে এখনো পর্যন্ত 'ত্রিপিটক' রূপে পালিশাস্ত্রের শ্রেণী বিভাজন হয় নাই বলিয়া মনে হয় এবং খৃঃ পুঃ প্রথম শতাব্দীতে বট্টগামনী কর্তৃক ত্রিপিটক লিপিবন্ধ করিবার পূর্ব পর্যন্ত পালিশাস্ত্রের সংশোধন পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হইয়াছে এমন কি সুত্তবিভঙ্গ ও নিন্দেসের মত টীকা গ্রন্হও অনুপ্রবিষ্ট হইয়াছে। বিষয়বস্তু ও বিভিন্ন সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করিয়া বিমলা চরণ লাহা পালি ত্রিপিটকের গ্রহগুলির নিম্নলিখিত কালক্রম (chronology) নির্দেশ করিয়াছেন:
১। বর্তমান ত্রিপিটকের সকল গ্রন্থের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে পুনঃ পুনঃ উল্লিখিত বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কীয় সাধারণ উক্তি বা বিবরণ।
২।দুই বা ততোধিক গ্রন্থে প্রাপ্ত একই কাহিনী।
৩। শীলসমূহ, প্রস্তাবনা ব্যতীত পারায়নবঙ্গ ও অট্ঠকবঙ্গের কবিতাগুলি, শিক্ষাপদসমূহ।
৪। দীঘনিকায়ের প্রথম খন্ড, মজঝিমনিকায়, সংযুত্তনিকায়, অঙ্গুত্তর- নিকায় এবং পাতিমোখের প্রাচীন ১৫২টি নিয়ম।
৫। দীঘনিকায়ের ২য় ও ৩য় খন্ড, থের-থেরীগাথা, জাতক, সুত্তবিভঙ্গ, পটিসম্ভিদামঙ্গ, পুষ্পলপঞঞত্তি, বিভঙ্গ।
৬। বিনয় মহাবঙ্গ ও চুল্লবঙ্গ, ২২৭ টি নিয়ম সমন্বিত সম্পূর্ণ পাতিমোক্খ, বিমানবন্ধু, পেতবন্ধু, ধম্মপদ এবং কথাবন্ধু।
৭। চুল্লনিন্দেস, মহানিন্দেস, উদান, ইতিবৃত্তক, সুত্তনিপাত, ধাতুকথা, যমক ও পট্ঠান।
৮। বুদ্ধবংস, চরিয়াপিটক ও অপদান।
৯। পরিবারপাঠ।
১০। খুন্দক পাঠ।
অভিধম্ম পিটকের অস্তিত্ব সম্পর্কে আধুনিক পণ্ডিতগণ সন্দেহ পোষণ করিলেও খৃঃ পুঃ তৃতীয় শতাব্দীতে অন্ততঃ বিনয়পিটক ও সুত্তপিটক যে সংকলিত হইয়াছিল সেই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। ইহার প্রধান সাক্ষ্য সম্রাট অশোকের শিলালিপি। পালি শাস্ত্রে যে নৈতিক চরিত্রনীতি, সহনশীলতা, পরোপকারিতা ও আত্ম পর্যবেক্ষণের রীতি প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা অশোকের শিলালিপিতেও ধ্বনিত হইয়াছে এবং উভয়ের মধ্যে প্রকাশ ভঙ্গিমায়ও সাদৃশ্য দেখা যায়। বেণীমাধব বড়ুয়া, হলুশ (Hultzsch) প্রভৃতি পণ্ডিতগণ পালি শাস্ত্র হইতে উদ্ধৃতি দিয়া শিলালিপির সহিত সাদৃশ্য দেখাইয়াছেন। ভারু শিলালিপিতে অশোক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উদ্দেশ্য করিয়া বলিয়াছেন, "যে কে চি ভংতে ভগবতা বুধেন ভাসিতে সবে সে সুভাসিতে বা", তাহা অঙ্গুত্তরনিকায়ে উল্লিখিত "যং কিঞ্চি ভগবতা সম্মা সমুদ্ধেন ভাসিতং সম্বং তং সুভাসিতং”-এর প্রতিধ্বনি। একই শিলালিপিতে বুদ্ধ, ধর্ম', সঙ্ঘের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়া সন্ধর্মে'র দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য যে সাতটি ধর্মপর্যায় ভিক্ষুদের শ্রবণ ও মননের জন্য নির্দেশ দিয়াছেন সেইগুলি পালি শাস্ত্রে নিহিত আছে।
ভারহৃত ও সাঞ্চী স্তূপে খৃষ্টপূর্ব-দ্বিতীয়/প্রথম শতাব্দীতে খোদিত শিলালিপি ও ভাস্কর্য হইতেও পালি শাস্ত্রের বিষয়বস্তু ও শ্রেণীবিভাজনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐ সমন্ড ভাস্কর্যে বৃদ্ধজীবনের যে সমস্ত দৃশ্য চিত্রিত হইয়াছে তাহাতে প্রমাণিত হয় যে সেই সময়ে বুদ্ধের জীবন কাহিনী রচনা যথেষ্ট পরিণতি লাভ করিয়াছিল এবং সেইগুলি আমরা পালি সুত্তগুলিতে, বিশেষতঃ নিদানকথা, ললিতবিস্তর, মহাবস্তু প্রভৃতি গ্রন্থগুলিতে দেখিতে পাই এবং শিলালিপিসহ যে সমস্ত জাতক কাহিনী চিত্রিত হইয়াছে, সেই- গুলিও পালি জাতকগ্রন্থে পাওয়া যায়। অধিকন্তু উৎসর্গিত স্তূপ শিলা- লিপিতে ভিক্ষুদের উপাধিরূপে 'ভাণক' অর্থাৎ আবৃত্তিকার, 'সুতংতিক' অর্থাৎ সূত্র আবৃত্তিকার, 'পচনেকায়িক' অর্থাৎ পঞ্চনিকায়জ্ঞ, 'পেটকিন' অর্থাৎ পিটকবিশারদ, 'ধম্মকথিক' অর্থাৎ 'ধর্ম' প্রচারক' শব্দগুলি উল্লিখিত আছে। উপরোক্ত বিবরণ হইতে সহজেই অনুমান করা যায় যে খৃষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে অর্থাৎ অশোকের সম সময়ে একটি বৌদ্ধ শাস্ত্র সংগ্রহ বিদ্যমান ছিল যাহা বিভিন্ন পিটকে ও পঞ্চ নিকায়ে বিভক্ত ছিল। এইরূপ বিভাগ আমরা বর্তমান ত্রিপিটকে পাই।
'ত্রিপিটক' (পিটকত্তয়ং) শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খৃষ্টীয় প্রথম/ দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত মিলিন্দ পঞ্জহ (মিলিন্দ প্রশ্ন) গ্রন্থে। এই গ্রন্থে যে সকল ত্রিপিটকের ও অন্যান্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, তাহাতে মনে হয় ঐ সকল গ্রন্থ বুদ্ধের পরিনির্বাণের দুইশত বৎসরের মধ্যে রচিত হইয়াছিল এবং ত্রিপিটক বহির্ভূত গ্রন্থাবলী, দীপবংস, মহাবংস ও ত্রিপিটকের গ্রন্থাবলীর টীকা মন্হগুলির (অঠকথা) বিবরণ হইতেও ইহা প্রমাণিত হয়। মোট কথা খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে যে পালি ত্রিপিটকের অস্তিত্ব ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
অধিকন্তু, বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশ হইতেও পালি শাস্ত্রের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয়। ঐ সংস্কৃত সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত গ্রহগুলি কিছু বিশুদ্ধ সংস্কৃতে ও কিছু মিশ্র সংস্কৃতে রচিত। মধ্য এশিয়ায় প্রাপ্ত পুঁথি, চৈনিক ও তিবতী অনুবাদ এবং কাশ্মীর ও নেপালে প্রাপ্ত পুঁথি হইতে প্রমাণিত হয় যে মূল সর্বান্তিবাদীদের একটি সম্পূর্ণ 'সংস্কৃতপিটক' বিদ্যমান ছিল। সংস্কৃত পিটক ও পালিপিটকের মধ্যে শব্দপ্রয়োগে ও বিষয় বিন্যাসে কিছু ব্যতিক্রম থাকিলেও উভয়ের মধ্যে মূল অংশে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে এবং তাহাতে মনে হয় তাহাদের পটভূমিকায় একই ঐতিহ্য বর্তমান ছিল। তবে পালি সংস্করণই সর্বতোভাবে প্রাচীনতর ও অবিসংবাদিতভাবে উত্তম। পালি ত্রিপিটক খৃঃ পুঃ প্রথম শতাব্দীতে সিংহলে প্রথম লিপিবদ্ধ করা হইলেও ইহাতে সম্রাট অশোক এবং সিংহল সম্পর্কে কোন উল্লেখ নাই। ইহাতেও প্রমাণিত হয় যে ত্রিপিটকের মূল অংশ অশোকের পূর্বে ভারতবর্ষে সংকলিত হইয়াছিল এবং সিংহলী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ সেই পালি শাস্ত্র পরম বিশ্বস্ততা সহকারে দুই হাজার বৎসর ব্যাপী রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে ত্রিপিটক ও ত্রিপিটক বহির্ভূত মহাবলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হইল।
গ্রন্থনির্দেশ
১। Winternitz, History of Indian Literature, II. P.8.
২। Majjhima Nikāya, I. P.133; Milinda Panha, P. 345.
৩। Cullavagga, V, 4; VI, 13; IX, 5
81 Winternitz, ঐ, P. 11.
৫! B. C. Law, History of Pali Literature, Vol. I. Intro- duction.
৬। Dr. Satya Ranjan Banerji, A Handbook of Sanskrit
Philology, P, LXXXI.
৭। W. Geiger, Pali Literature and Language, PP, 2ff.
৮। B. M. Barna, Aśoka and His Inscriptions, P. 7.
৯। A. C. Woolner, Introduction to Prakrit, P. 73.
১০। Anguttaranikāya, IV, P, 163,
সংগৃহীতঃ বৌদ্ধ সাহিত্য - বিনয়েন্দ্রনাথ চৌধুরী