Sunday, November 10, 2024

অ- বর্ণের অভিধান - ২

 অকতাগস [অকত+আগস] পাপ না করিয়া। => আগু, আগস

অকতাভিনিবেস (বিণ) অমনোযোগী। => কতাভিনিবেস

অকত্তব্ব (বিণ) অকর্তব্য, অনুচিত, যাহা করা উচিত নয়, যাহা করিবার নয়। (ক্লী) অকর্তব্য, অকর্তব্য কার্য, অনুচিত কার্য, করিবার নয় এমন কার্য।

অকত্তব্বররূপ => অকিরিযরূপ। অকিরিযরূপ। => অকত্থতি (ক্রি) অহঙ্কার না করা, আছে বলিয়া গর্ব না করা। (ব-বিণ) অকথমান।=> কথতি

অকথং কথিন (বিণ) সন্দেহমুক্ত (বর্ণনায়) অরহস্ত। (দীর্ঘনিকায় অর্থকথা বর্ণনা অনুসারে ইহার অর্থ) 'ইহা কিরূপে হইল এবং কিরূপে' ইহা না বলিয়া। (বি-ভা) তিন্ন বিচিকিচ্ছো বিহরতি - অকথঙ্কথী কুসলেসু ধর্ম্মেসু (দীর্ঘনিকায়)। ঝাযী অনেজো অকথঙ্কথিন (ধর্মপদ)।

অকথন (ক্লী) না বলা, অকথন, কথা না বলা, আলাপ না করা, (ক্রোধবশে) আলাপ না করা।

অকথনসীল (বিণ) অকথনশীল, যাহার কম কথা বলিবার অভ্যাস আছে, বাচাল নহে এমন, অনতিভাষী, অল্পভাষী।

অকদ্দম (বিণ) অকর্দম, পক্ষহীন, কর্দমমুক্ত, ধূলি কিংবা কর্দম নাই এমন, পবিত্র, পরিষ্কৃত, নিষ্পাপ।

অকনিট্‌ঠ (বিণ) অকনিষ্ঠ, ছোট নয় অথবা কনিষ্ঠ নয় এমন, ক্ষুদ্র নয় অথবা ছোট নয় এমন অর্থাৎ বৃহত্তর, ঊর্ধ্বতম। (পুং) অকনিষ্ঠ রূপব্রহ্মলোক। ইহা ডবাগ্ন বা রূপব্রহ্মলোকের ঊর্ধ্বতন ভূমির নামবিশেষ।

অকনিট্‌ঠগামিন (বিণ) অকনিষ্ঠ রূপব্রহ্মলোকে গমনকারী, যিনি ধ্যান-সাধনায় ডবাগ্ন অকনিষ্ঠ ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হইবার উপযুক্ত হইয়াছেন। পরিনিব্বাযিন।

অকনিটঠভবন- অকনিষ্ঠ  রূপব্রহ্মলোক বা ব্রহ্ম-আবাস।

অকন্তু (বিণ) অবাঞ্ছিত, অনিচ্ছিত, নিরানন্দজনক, অস্বীকার্য। কন্ত ।

অকন্তেন (ক্রি-বিণ) অকরুণ নিষ্ঠুর বচনে, কাশ কথায়, নিরানন্দ জনক বা অপ্রীতিকর কথায়।

ব্রহ্ম-আবাস।(বিণ) [অ+কন্দিত) ক্রন্দন বা বিলাপ করে না বা করে নাই এমন, অননুতপ্ত, শোকহীন। কন্দিত।

অকপণ (বিণ) [অকপণ দরিদ্র নহে এমন, ধনী। কপণ (১)।

অকল্প (বিণ) অনুপম, নিরুপম, অতুল, অতুলনীয়, কল্পনার অতীত।

অকপ্পিয (বিণ) [অ কপ্পিয) ১ আইনসঙ্গত নহে এমন, বিধিমত নহে এমন, অবৈধ, অসঙ্গত, অযোগ্য, অপ্রকৃত, অনুপযুক্ত। কপ্পিয (১)। (ক্লী) অসঙ্গত বিষয় বা ব্যাপার, অবৈধ অবস্থা, যে সব বস্তু ভিক্ষুরা গ্রহণ করিতে পারে না, অযোগ্য বা অনুপযুক্ত দ্রব্য। ২ কাল বা সময়মুক্ত, সংসারমুক্ত। (বর্ণনায়) অর্হৎ বা "অরহত"।

অকপ্পিয ভণ্ড (ক্লী) অনুপযুক্ত ভাণ্ড, যেসব বস্তু গ্রহণ ভিক্ষুদের পক্ষে নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ বস্তুর তালিকা।

অকম্প (বিণ) অকম্পিত, অসঞ্চালিত, কম্পিত হয় না এমন।

অকম্পন (বিণ) কম্পিত হয় না এমন, কাঁপে না এমন, সাহসী, নির্ভীক।

অকম্পন সভাব (পুং) অকম্পন স্বভাব, নির্ভীক অবস্থা, সাহস। অবেধ ধৰ্ম্ম। (বিণ) অকম্পন স্বভাবযুক্ত, অবিচলিত, অক্ষোভ্য, স্থির, শান্ত। অবেধ

অকম্পমান (ব-বিণ) কম্পিত হয় না এমন, অকম্পমান, দৃঢ় আছে এমন, নিরুদ্বিগ্ন, ইতস্তত করে না এমন। => কম্পিত

অকম্পিয (বিণ) অকম্পিত, অচল, কম্পনরহিত, স্থাবর, স্থির, অটল, দৃঢ়, অপরিবর্তনীয়, অপরিবর্তনশীল, কঠিন, স্থায়ী, অবিচলিত, অনুদ্বিগ্ন। কম্পিয। (ক্লী) দৃঢ়তা অর্থাৎ যাহাকে শ্রদ্ধাবল-বীর্যবল ইত্যাদি 'পঞ্চবলানি বলা হয়।

অকম্পিযত্ত (ক্লী) অকম্পিত অবস্থা, অপরিবর্তনশীলতা, দৃঢ়তা, স্থিরতা, অটলতা।

অকস্মক (বিণ) কর্মে নির্ভরশীল নহে এমন, অকর্মক বা অকর্মণ্য, কর্মসম্বন্ধীয় নহে এমন, কাজের নহে এমন, কাজে লাগে না এমন। => কম্পক

অকস্মকাম (বিণ) অলস, নিষ্কর্মা, জড়, নিষ্ক্রিয়, কাজ করিতে অনিচ্ছুক, অনুৎসাহী, অকর্মী। (বিপ) কৰ্ম্মকাম।

অকস্মজ (বিণ) অকর্মজ, কর্মফল দ্বারা অনুৎপন্ন, অকর্মসম্ভূত, কর্ম দ্বারা সংঘটিত হয় না এমন। (মিল্কিন্দ প্রশ্ন) অকস্মজ আকাস, অকস্মজ নিব্বান।

অকম্মজ আকাস-অকর্মজ শূন্যতা অর্থাৎ কর্মের ফল দ্বারা সম্ভূত হয় না এমন অবস্থা। (তুলনীয়) অকস্মজ নিব্বান।

অকস্মজ নিব্বান-পাপ ও পুণ্য যে কোনো কর্মহীন অবস্থায় শূন্যতামূলক অসম্ভূত নির্বাণ, নিরোধ বা নিবৃত্তিমূলক নির্বাণ, কর্মদ্বারা সম্ভূত নহে এরূপ নির্বাণ। ⇒ অকস্মজ।

অকস্মঞঞ (বিণ) অকর্মণ্য, অপ্রস্তুত, অনুপযুক্ত, কাজের অযোগ্য, অলস, জড়, মন্থরগতি। কস্মঞঞ।

অকস্মঞঞতা (স্ত্রী) অকর্মণ্যতা, কাজের অযোগ্যতা, অনুপযুক্ততা, জড়তা, নিষ্ক্রিয়তা, মন্থরতা, নিশ্চেষ্টতা, অক্ষমতা, যাহা সহজে নড়ানো বা সরানো যায় না এমন অবস্থা, অলসতা। (ধর্মসঙ্গণী অর্থকথা) চিত্তগেলঞঞং। (বিভঙ্গ) চেতসো লীনত্তং

বর্ণের উচ্চারণ স্থান

১। কখগঘঙ অ আ হ-ইহাদের উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ; এজন্য ইহাদিগকে কণ্ঠ্যবর্ণ (কন্ঠজা-Gutturals)  বলে।

২। চছজ ঝ ঞয ইঈ-ইহাদের উচ্চারণ স্থান তালু; এজন্য ইহাদিগকে তালব্যবর্ণ (তালুজা-Palatals) বলে।

৩। পফবভ ম উ উ-ইহাদের উচ্চারণ স্থান ওষ্ঠ; এজন্য ইহাদিগকে ওষ্ঠ্যবণ (ওটঠজা- i.abials) বলে।

8। ট ঠ ড ঢ ণর ল-হহাদের উচ্চারণ স্থান মুদ্ধা, এজন্য ইহাদিগকে মুদ্ধন্য বর্ণ (মুদ্ধজা-Linguals) বলে।

৫। ত থ দ ধনলস-ইহাদের উচ্চারণ স্থান দন্ত; এজন্য ইহাদিগকে দন্ত্য বর্ণ (দন্তজা-Dentals) বলে।

৬। এ-ইহার উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ ও তালু; এজন্য ইহাকে কণ্ঠ- তালব্য (কণ্ঠ-তালুজ বর্ণ--Gutturo-palatals) বলে 

৭। ও-হহার উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ ও ওষ্ঠ; এজন্য ইহাকে (কণ্ঠ্যৌষ্ঠ্য- বর্ণ কণ্ঠোটঠজে- Gutturo-labial) বর্ণ বলে।

৮। ব (অন্তঃস্থ।-ইহার উচ্চারণ স্থান দন্ত ও ওষ্ঠ; এজন্য ইহাকে দন্তৌষ্ঠ্য (দন্তোটঠজো-Dento-labial) বলে।

৯। ং (নিগ্‌গহাত) এর উচ্চারণ স্থান নাসিকা; ইহা স্বরবর্ণের পরে ব্যবহৃত হয়।

(১) অকবগ্নেহা কণ্ঠজা (২) হ চর তালুজা (৩) উপবঙ্গ। ওট্‌ঠজ।

(৪) ট বগরলা যুদ্ধজা (৫) ৩ বধূগণনা দপ্তজা (৬) একণ্ঠতালুজো।

(৭) ও কণ্ঠোজে। (৮) বো দণ্ডোজে।।

(৯) বিন্দুচুলামনাকারো নিগ গৃহীতং তি বুচ্চতে।

কেবলপযোগত্ত। অকারো সন্নিধীয়তে।


কয়েকটি বর্ণের নানারূপ উচ্চারণ

১; অ এই বর্ণ টীর উচ্চারণ বাঙ্গলা অ এবং আ এর মাঝামাঝি।

২। পালিতে বর্গীয় ব এবং অন্তঃস্থ ব এর উচ্চারণে বিশেষ প্রভেদ দেখা যায়। যে ব স্থানে উ উ হয়, উহা অন্তঃস্থ। যথা-বদ (উচিত), বচ্ (উত্তো)।

উ এবং ও স্তানে যে বয় উহাও অন্তঃস্থ। যথা-অনু+এতি - অন্বেতি, খে। + অস্ত্র = খুসস।

বকার ভেদ-বিষয়ে সংস্কৃত কারিকা এই:-

উদুটো যত্র বিদ্যেতে যোঃ বঃ প্রত্যয় সন্ধিজঃ।

অন্তঃস্তং তং বিজানীয়াৎ তদন্যে বর্জ্য উচাতে ॥ পালিতে অন্তঃস্থ ব কারের উচ্চারণ "উয়” এর ন্যায়।

৩। য বর্ণটীর অ্যকারের ন্যায় উচ্চারণ হয়।

৪। 'ল এই বর্ণ টার উচ্চারণ বাঙ্গালা ড় এর ন্যায়। যথা-এলক (এডক)।


Facebook Page

Monday, November 4, 2024

পালি ভাষার উৎপত্তি


পালি ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতেরা ভিন্নমত পোষণ করেন। কোনো কোনো পণ্ডিত অনুমান করেন প্রত্ন ভারতীয় আর্য ভাষা (old Indo-Aryan) গঠনের চারিটি স্তর। যথা, বৈদিক, সংস্কৃত, পালি এবং সাহিত্যিক প্রাকৃত। এই চারিটি ভাষার সঠিক সন তারিখ নির্ধারণ করা সহজ নয়। ভাষাতাত্বিকেরা বৈদিক ও সংস্কৃতকে প্রত্ন-ভারতীয় (O.I.A.) পর্যায়ে ফেলিয়াছেন। অবশ্য এই দুইটি ভাষা মূলত একই উৎসজাত হইলেও ইহাদের মধ্যে বহু পার্থক্য বিদ্যমান। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে বৈদিক ভাষারই সরলীকৃতরূপ সংস্কৃত এবং সংস্কৃত ক্রমশ সরলীকৃত ও রূপান্তরিত হইয়া প্রাকৃতরূপ ধারণ করিয়াছে।  বৈদিক ভাষায় ভারতীয় আর্যদের সাহিত্যকীর্তি ও দেবদেবীর বন্দনাগীতি রচিত। ইহার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় বেদ, উপনিষদ ও ব্রাহ্মণে। ইহাদের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। বৈদিক ভাষাকে পাণিনি প্রভৃতি বৈয়াকরণেরা ব্যাকরণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া একটা লিখিত শিষ্ট ভাষার সৃষ্টি করেন ইহাই বর্তমানে সংস্কৃত ভাষা নামে অভিহিত। ইহাকে সংস্কৃত, 'পরিমার্জিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া লইয়াছেন বলিয়া 'সংস্কৃত' বলা হয়। পালি মধ্য স্তরের ভাষার অন্তর্গত। প্রাচীন প্রাকৃত বা তদানীন্তন কথ্য ভাষা হইতে ইহার উৎপত্তি। ইহার উৎপত্তিকাল সঠিকভাবে নির্ধারণ করা না হইলেও খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ হইতে ৬০০ অব্দে বলিয়া অনুমান করা যাইতে পারে। বৈদিক আর্য ভাষার সহিত সংস্কৃতের ভাষায়
যে রূপ সম্পর্ক প্রাকৃত ভাষার সহিতও পালি ভাষার সেইরূপ সম্পর্ক। বৈদিক ভাষায় যেইরূপ দেবদেবীর বন্দনামূলক গীতি সাহিত্য রচিত বলিয়া উহাকে দেব ভাষা বলা হয়; সেইরূপ পালিভাষাকেও দেব ভাষা বলা যায়। কারণ এই ভাষাতেই বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ 'ত্রিপিটক' রচিত হইয়াছে। সেই হিসাবে বুদ্ধকে ভাষা আন্দোলনের প্রথম উদ্যোক্তা বলা যায়। তিনিই প্রথম কথ্যভাষায় জনসাধারণের নিকট তাঁহার নবধর্ম প্রচার করেন। বৈদিক আর্য ভাষা হইতে সংস্কৃত এবং সাহিত্যিক প্রাকৃতের ক্রমপরিণতির বহু তথ্য এই পালি ভাষার মাধ্যমে পাওয়া যাইতে পারে। কারণ সন তারিখ বিবেচনা করিলে পালি ভাষার স্থান বৈদিক আর্য ও সংস্কৃত ভাষার মাঝামাঝি। ভারতীয় আর্য ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে পালি ভাষার স্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা, উড়িয়া, হিন্দী, মৈথিলী ও অসমিয়া প্রভৃতি নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার সহিত ইহা ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। ইহা ছাড়া সিংহলী, বর্মী ও শ্যামদেশীয় ভাষাসমূহের উপরও পালি ভাষার প্রভাব সুস্পষ্ট।

এই পালি ভাষা প্রথমত কথ্যভাষা হইলেও পরে সাহিত্যের রূপ পাইয়া পুরোপুরি লিখিত ভাষায় পরিণত হয়। সিংহল ও ব্রহ্মদেশীয় পালি পণ্ডিতেরা পালিকে 'মাগধী নিরুক্তি' বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। গৌতম বুদ্ধ যে দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন সেই দেশের নাম মগধ বা পটলিপুত্র। তিনি যে ভাষায় কথা বলিতেন এবং ধর্ম প্রচার করিতেন উহার নাম পালি বা মাগধী - এই দুই ভাষার মধ্যে প্রকৃতিগত কোনো ভেদ নাই। সিংহলী পালি বৈয়াকরণেরা শুধু ইহাতে সন্তুষ্ট থাকেন নাই। তাঁহারা সংস্কৃত পণ্ডিতদের ন্যায় পালিকে দেবভাষা বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন। তাঁহারা বলেন এই পালি ভাষা মানবের আদি ভাষা। এই ভাষায় আদিকালের মানুষেরা কথা বলিতেন। স্বর্গের দেবতা ও অরণ্যে নিক্ষিপ্ত মানব শিশু পালি ভাষায় কথা বলিয়া থাকেন। সিংহলী পণ্ডিতদের মধ্যে পালি ভাষার মাহাত্ম্য সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত প্রবাদ প্রচলিতঃ

"সা মাগধী মূল ভাষা নরা যা আদি কপিপকা,

ব্রহ্মাণো চসুতালাপা সম্বুদ্ধা চাপি ভাসরে। "

মাগধী বা পালি ভাষা আদিকল্পের মানবের মূল ভাষা। সেই অশ্রুতপূর্ব ভাষায় বুদ্ধ তাঁহার নব ধর্ম প্রচার করিয়াছেন।

বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা আরও বলেন যদি কোনো শিশু ইংরেজ মাতার গর্ভে জার্মান পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করে, তবে সেই শিশু মাতাপিতার মধ্যে যাহার সঙ্গে থাকিবে তাহার ভাষায় কথা বলিবে। আর যদি সেই শিশু মাতাপিতা কাহারও সঙ্গে না থাকিয়া জঙ্গলে প্রতিপালিত হয় তবে সে মাগধী বা পালি ভাষায় কথা বলিবে, কারণ পালি তাহার সহজাত ভাষা। সমস্ত ভাষারই পরিবর্তন হয়, কেবল পালির বা মাগধী ভাষার কোনো পরিবর্তন হয় না।

পালি ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস যাহাই হউক না কেন বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারিত বাংলা ভাষার ন্যায় পালি ভাষাও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে অল্পসময়ে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করে। দেখিতে দেখিতে অসংখ্য গ্রন্থ এই ভাষায় রচিত হইয়াছে। শুধু ধর্মগ্রন্থ নহে জাতক, অবদান, মহাবংশ, দীপবংশ, চুলবংশ এবং আরও বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থ ক্রমান্বয়ে রচিত হইতে থাকে। ভাষার যথাযথ শ্রীবৃদ্ধির জন্য বিবিধ ব্যাকরণ গ্রন্থও রচিত হইয়াছে। ইহাতে দেখা যায় পালি ভাষা নিতান্ত অপাংক্তেয় অশিষ্ট লোকের ভাষা বলিয়া অবহেলা করিবার দুঃসাহস কাহারও নাই। ভগবান বুদ্ধের জ্ঞানগর্ভ উপদেশ ও সারিপুত্র, মৌদগল্পায়ন, মহাকাত্যায়ন, পূর্ণমস্তানিপুত্র, বুদ্ধঘোষ, বুদ্ধদত্ত প্রমুখ আরও বহু মনীষীর রচনায় এই ভাষা সমৃদ্ধ। বুদ্ধ বাণীর শক্তিশালী বাহক হিসাবে এই ভাষা বৌদ্ধদের কাছে পরম পবিত্র। এখনও সিংহল, বর্মা, থাইল্যাণ্ড, কম্বোডিয়া, তিব্বত, জাপান, চীন, কোরিয়া, মাঞ্চুরিয়া, প্রভৃতি সকল বৌদ্ধদেশে এই ভাষার পঠন-পাঠন, চর্চা ও গবেষণা করা হইতেছে।

সংগৃহীতঃ পালি সাহিত্যের ইতিহাস ১ম খণ্ড - রবীন্দ্রবিজয় বড়ুয়া


Facebook Page

অ বর্ণের অভিধান-১

অ- বর্ণমালায় স্বরবর্ণের আদ্যক্ষর বা আদ্যবর্ণ। ইহার উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ, এইজন্য ইহাকে কণ্ঠজ বর্ণ বলে।  পদান্বয়ী অব্যয়। 'আ' এর ব্যবহার উপপদরূপে বা সংক্ষিপ্তভাবে এবং দ্বিত্ব ব্যঞ্জনের পূর্বে বসে, যথা- ১. অক্কোসতি (সংস্কৃত শব্দ-আক্রোশ);২. অকখাতি (সংস্কৃত শব্দ-আখ্যা)

১. অংস (পুং, ক্লী)  অংস, স্কন্ধ, কাঁধ, স্কন্ধদেশের অর্ধাঙ্গুলি পরিমিত স্নায়ুবিশিষ্ট স্থান।  ভাগ, অংশ, খণ্ড, স্থান। (দীর্ঘনিকায়) অতীত অংসে অতীতে, পূর্বকালে, ইতঃপূর্বে, পুরাকালে, পূর্বভাগে।

২. অৎসকূট (পুং, ক্লী) অংসকূট, স্কন্ধ, কাঁধ, কণ্ঠাস্থি, স্কন্ধস্থিত মাংসপিণ্ড, যেমন--ষাঁড়ের স্কন্ধস্থিত মাংসপিণ্ড বা চোট। অংস (স্কন্ধ) স্থিত কূট (পর্বতশিখর) অর্থাৎ উন্নত মাংসপিণ্ড।

৩. অংসপুট = অসসপুট 

৪. অংসবদ্ধক (পুং, ক্লী) = অংসবট্টক। 

৫. অংসবন্ধক (পুং, ক্লী) = অংসবট্টক। 

৬. অংসবন্ধন (পুং, ক্লী) = অংসবন্ধনী, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যবহৃত একাংশিক বস্ত্র। = অংসবটুক।

৭. অংসবটুক (পুং, ক্লী) স্কন্ধচামাটি, অংসকূট সদৃশ স্কন্ধস্থিত চামড়ার থলিবিশেষ। অৎসবন্ধন।

৮. অংসবত্তক = অংসবটুক। অৎসবটুক।

৯. অংসি (পুং) (বৈদিক শব্দ: অশ্রি, অশ্রু অশনি), ধার, প্রান্ত, কোণ।

১০. অসিযতি (ক্রি) = অস্মিযে। অস্মিযে।

১১. অংসু (পুং) (সংস্কৃত-অংশু)  ১ । সূর্যরশ্মি, আলোর ছটা।  ২। সূতা, সূত্র, তত্ত্ব।

১২. অংসুক (ক্লী) কাপড়, বস্ত্র।

১৩. অংসুমালিন (পুং) সূর্য।

১৪. অংসুমালী (পুং) সূর্য। 

১৫. অইহব তুণ্ডি-কণ্টকবন (সাহিত্যে), ঘোড়ার দাঁত। অসকণ।

১৬. অকক্কস (বিণ) অকর্কশ, অবন্ধুর, মসৃণ, তেলা, চিক্কণ, নরম, কোমল, সহজ, স্নিগ্ধ, শান্ত, বাধাহীন, অপ্রতিহত। = অকাচ, অগড়িত।

১৭. অকক্কসঙ্গ (বিণ) [অ+ কক্কস অঙ্গ মসৃণ বা সুন্দর অঙ্গযুক্ত। অকক্কস।

১৮. অকঙ্খলতা = অকঙ্খলতা।

১৯. অকঙ্খল (বিণ) কর্কশ বা শক্ত নহে এমন, কোমল, নরম, হৃদয়বান, দয়ার্দ্র, সুখকর, মৃদু, মনোহর, আনন্দজনক, আমোদপ্রিয়, "প্রফুল্ল, অবন্ধুর, মসৃণ, তেলা, চিক্কণ, সহজ, স্নিগ্ধ, শান্ত, বাধাহীন, অপ্রতিহত। = অফরুস। অকক্কসঙ্গ।

২০. অকঙ্খলতা (স্ত্রী) সভ্যতা, ভদ্রতা, শান্তভাব, দয়ার্দ্রতা, প্রফুল্লতা। = সহ।

২১. অককঙ্খলভাব (পুং) শান্তভাব, দয়াভাব, ভদ্রভাব, সভ্যতা।

২২. অককখল বচত-দয়াপূর্ণ কথা, সুখকর কথা, শান্তবাক্য। = অফরুস-বাচতা, মুদুবাচতা।

২৩. অকঙ্খ (বিণ) সন্দেহমুক্ত, নিঃসন্দেহ, নিশ্চিত, যিনি সন্দেহবিমুক্ত, যিনি বিজ্জা (বিদ্যা) বা যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী, পূর্ণজ্ঞানী। (যৌগিকে) অক অপিহ অনুপম। (সুত্তনিপাত) অখিল অকঙ্খ। (তুলনীয়) বিতিন্নকঙ্খ, নিকঙ্খ।

২৪. অকঙ্খা (স্ত্রী) নিঃসন্দেহ অবস্থা, সন্দেহরহিত অবস্থা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, স্পৃহা, অপেক্ষা, জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান, সন্দেহমুক্ত অবস্থা, নিশ্চিত ভাব।

২৫. অকাঙ্খিন (বিণ) নিঃসন্দেহ, অতি বিশ্বাসী, সাহসী, সুনিশ্চিত, নিশ্চিত, বিশ্বাসযোগ্য, সন্দেহশূন্য, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য। (তুলনীয়) অকঙ্খ।

২৬. অকচ্ছু (বিণ) অকথিত। কচ্ছু (৩)।

২৭. অকট (বিণ) অকত। অকত।

২৮. অকটযূস (পুং,ক্লী) স্বাভাবিক রস, প্রাকৃতিক বা স্বভাবসিদ্ধ রস। যুস (২)।

২৯. অকটঠ (বিণ) অকর্ষিত, অপ্রস্তুত, চাষ দেওয়া হয় নাই এমন। কট্ঠ (১)।

৩০. অকঠিনতা (স্ত্রী) কঠিনতার অভাব, দৃঢ়তার অভাব, কোমলতা, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা। (বিপ) কঠিনতা। (যৌগিকে) অকঠিনতা অকক্খলতা। (তুলনীয়) অকঠিনভাব (ধর্মসঙ্গণী অর্থকথা)।

৩১. অকণ (বিণ) ক্ষুদ-কুড়াহীন, কণাহীন, ভাঙ্গা কণা নাই এমন, ঢেঁকি-ছাটা, ক্ষুদ নাই এমন, গোটা গোটা চাউল। ⇒ কণ।

৩২. অকণিকা (বিণ) দাগহীন, নির্দোষ, নিষ্কলঙ্ক, তিল নাই এমন, দোষশূন্য। (বিপ) সকণিকা। কণিকা 

৩৩. অকণ্টক (বিণ) ১ অকণ্টক, কন্টকহীন, নিষ্পন্টক, শত্রুহীন। নিক্কণ্টক। ২ (চরিত্রে) চোরের দ্বারা নিরুপদ্রব, শান্ত, বিনাক্ষতিতে, ক্লেশহীন, আরামজনক, সহজ, সোজা, সুখজনক, ক্ষতিকর নহে এমন, মুক্ত, বাধাহীন। (বিপ) সকণ্টক। (তুলনীয়) কণ্ডক। কণ্টক (৪)।

৩৪. অকণহ (বিণ) কৃষ্ণবর্ণ নহে এমন, যাহা নীচ বা হীন নহে, উজ্জ্বল, আঁধার বা কালো বর্ণ নয় এমন, অসৎ প্রকৃতির নয় বা পাপী নয় এমন, নিষ্পাপ। (দীর্ঘনিকায়) অকল্প-অসুব্ধ। (জাতক) অকণ নেত্ত-উজ্জ্বল চক্ষু (পিঙ্গলনেও রাজার বর্ণনায়, মারের চক্ষু পিঙ্গলনেত্ত হইলেও ইহা মারের বিপরীত শব্দ)। অসুব্ধ।

৩৫. অকণ নেত্ত (বিণ) উজ্জ্বল চক্ষু, যাহার চক্ষুদ্বয় উজ্জ্বল। ⇒ অকল্প।

৩৬. অকত (অ-বিণ) [অ কত, ন কত] অকৃত, করা হয় নাই এমন, প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক।

৩৭. অকতকৰ্ম্ম (বিণ) অকৃতকর্ম, যাহার কাজ এখনও সম্পন্ন করা হয় নাই, যে ব্যক্তি কাজ সম্পন্ন করিতে পারে না।

৩৮. অকতকল্যাণ (বিণ) অকল্যাণকারী, অনুপকারী, অহিতকারী, অনিষ্টকারী। কতকল্যাণ।

৩৯. অকতকিব্বিস (বিণ) সচ্চরিত্রের, সৎ, সৎকর্মী। কতকিব্বিস। (পুং) সৎ ব্যক্তি, ধার্মিক লোক।

৪০. অকতঞঞ্জু (বিণ) ১ অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন, নিমকহারাম, উপকারীর উপকার স্বীকার করে না এমন। কতগুণং অজানান্তা (জাতক অর্থকথা)। ২ পুনর্জন্মরহিত জ্ঞান অর্থাৎ নিবৃত্তি বা নির্বাণ জ্ঞান (ধর্মপদ অর্থকথা)। (জাতক) অকতঞ্জ ক্রুরাপ, অকত এ সম্ভব-অকৃতজ্ঞ স্বভাবযুক্ত।

৪১. অকতংতা (স্ত্রী) অকৃতজ্ঞতা, উপকারীর উপকার স্বীকার না করা। (যৌগিকে) অকতঞঞতা অকতবেদিতা।

৪২. অকঞঞরাপ (বিণ) অকৃতজ্ঞ স্বভাবের। অকতঞঞসম্ভব।

৪৩. অকতঞঞ সম্ভব (বিণ) অকৃতজ্ঞ প্রকৃতির। অকতঞএ।

৪৪. অকতত্তা-অসমাপ্ত রাখিয়া, অনুপস্থিতে বা কর্তব্যকর্মে অবহেলা করিয়া।

৪৫. অকতথদ্ধ (বিণ) অদৃঢ়, অশক্ত, নরম, হালকা। কতথদ্ধ।

৪৬. অকতপরিগ্রহ (বিণ) অবিবাহিত, বিবাহ করে না এমন, দারপরিগ্রহ করে নাই এমন।

৪৭. অকতপাপ (বিণ) পাপকর্ম করে না এমন, পাপহীন, নিষ্পাপ, পুণ্যবান, ধার্মিক।

৪৮. অকতপাপকৰ্ম্ম-যে পাপকার্য করে নাই। কতপাপকৰ্ম্ম।

৪৯. অকতপুঞঞ (বিণ) অকৃতপুণা, অধার্মিক, যে ব্যক্তি পুণ্যকার্য করে না বা করে নাই। (পুং) পূর্ব পূর্ব জন্মের পুণ্যহীন ব্যক্তি।

৫০. অকতপুঞতা (স্ত্রী) পুণ্যকার্য না করিবার ফলে, পূর্ব পূর্ব জন্মের সঞ্চিত পুণ্য না থাকার ফলে।

৫১. অকতমল্লক (বিণ) অকৃত্রিম, আসল, প্রকৃত, স্বাভাবিক, বিশুদ্ধ, অকপট। (বিপ) কতকমল্লক।

৫২. অকতযোগ (বিণ) কাজের অযোগ্য, অশিক্ষিত, অনাবশ্যক, অকর্মণ্য, ফলপ্রদ নয় এমন।

৫৩. অকতলুদ্দ (বিণ) দয়ালু, সৎ, ভদ্র, সাধু, অহিংস্র।⇒ কতলুদ্দ।

৫৪. অকতলুদ্ধ (বিণ) নির্লোভ, অলোভী, লোভহীন। কতলুদ্ধ।

৫৫. অকতবুদ্ধি (বিণ) মূখ, বোকা। (বিপ) কতবুদ্ধি।

৫৬. অকতহথ (বিণ) অদক্ষ, সিদ্ধহস্ত নহে এমন, অচতুর, আনাড়ি, অপ্রস্তুত, নিপুণহস্ত নহে এমন। কতহখ।


Facebook Page

পালি বর্ণমালা (The Alphabet)

 ১। পালি ভাষাতে সর্বমোট একচল্লিশটি বর্ণমালা রহিয়াছে। তন্মধ্যে স্বরবর্ণ আটটি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ তেত্রিশটি।

স্বরবর্ণ (Vowels)

অ       আ      ই       ঈ       উ    উ      এ       ও

ব্যঞ্জনবর্ণ (Consonants)

ক      খ     গ       ঘ       ঙ

চ       ছ       জ     ঝ     ঞ

ট       ঠ       ড      ঢ      ণ

ত     থ     দ       ধ        ন

প     ফ       ব       ভ      ম

য     র      ল     ৰ  স      হ

ল     ং  

২। স্বরবর্ণের মধ্যে অ, ই, উ এই তিনটি বর্ণ হইতেছে হ্রস্বস্বর বা হ্রস্বমাত্রিক;  অবশিষ্ট আ, ঈ, উ, এ ও এই পাঁচটি বর্ণ হইতেছে দীর্ঘস্বর বা দীর্ঘমাত্রিক। 

যদিও 'এ' এবং 'ও' এই বর্ণ দুইটিকে দীর্ঘস্বর বলা হইয়াছে; কিন্তু এই দীর্ঘমাত্রিক বর্ণদ্বয় যুক্তব্যঞ্জনবর্ণের আগে বসিলে হ্রস্বমাত্রিক উচ্চারিত হয়। যেমন: মেত্তা, সেষ্ঠী, ওক্কমতি, যোত্তং।

পালি লেখার জন্য রোমান ও বাংলা স্ক্রিপ্ট




পালি শব্দের উৎপত্তি

'পালি' শব্দের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে বহু গবেষণা হইয়াছে। এই গবেষণার ধারা এতই বিক্ষিপ্ত যে উহার মধ্য হইতে সঠিক তথ্য উদ্ধার করা কষ্টকর। 'পালি' শব্দের অর্থ 'পঙতি' বলিয়া কোনো কোনো পণ্ডিতের অভিমত। প্রাকৃতে 'পত্তন' হইতে 'পট্টন' হয়। তদ্রূপ 'পতি' হইতে 'পট্টি' হওয়া স্বাভাবিক। ভাষাতত্বের নিয়মানুসারে ইহার মধ্যে কোনো ধারাবাহিকতা নাই। তথাপি 'পতি' পত্তি পট্টি পাটি পাড়ি পালি অথবা পতি> পত্তি পট্টি পড়িড় পল্লি পালি বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায় না। 'পালি' শব্দের মূল অর্থ 'পঙ্ক্তি' 'বীথি' বা 'শ্রেণী' বলিয়া পূর্বাচার্যগণ বুঝাইতে প্রয়াস পাইয়াছেন। কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে কে
হই কিভাবে 'সংস্কৃত 'পতি' শব্দ হইতে 'পালি' শব্দের উৎপত্তি হইল তাহা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন নাই। সংস্কৃত 'পতি' বলিতে আমরা পদের শেষ চরণ বুঝি। যেমন 'তথাচ সূত্র পতি'। মূলগ্রন্থ বুঝাইবার জন্যও 'পঙক্তি' শব্দের প্রয়োগ হয়।ও 'পিটকত্তয়ং পালিঞ্চ ত্সস অটঠ কথঞ্চ তং' এবং 'পালিযং বুত্ত নযেন' পালিতে বা মূলে এইরূপ বহু উদাহরণ পালি সাহিত্যে পাওয়া যায়। পালি ভাষায় 'তত্ত্ব' শব্দ 'পালি' শব্দের অন্যতম প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হয়। পালি বুঝাইতেও ঐ শব্দ প্রযুক্ত হইয়া থাকে। 'তন্ত্র', 'তন্ত্রী' অথবা 'তন্ত্রি' মূলত একই শব্দ।

অধ্যাপক ভি. আপ্তে 'পালি' শব্দের অর্থ করিয়াছেন 'তন্ত্র'। পালি ভাষ্যকার বুদ্ধঘোষ 'অক্ষর পতি' বা মূল শাস্ত্র বুঝাইতে 'ঋালি' শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। যেমন, 'নেব পালিষং ন অঠকথায়ং দিস্সতি'। ইহার অর্থ পালিতে বা অর্থ কথায় কোথাও দেখা যায় না। সেইরূপ 'জম্বুদীপে পন আবুসো পালিমত্তং অথি, অঠকথা পন নথি' ভারতবর্ষে কেবল পালি বা মূল আছে, অর্থকথা বা ভাষ্যগ্রন্থ নাই। 'যো পন অথমেব সম্পাদেতি ন পালিযং - যিনি কেবল মাত্র অর্থই হৃদয়ঙ্গম করেন, তিনি পালি বা মূল আয়ত্ত করেন না। উল্লিখিত উদাহরণ হইতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে 'পালি' শব্দ প্রথমত 'মূলশাস্ত্র' বা ত্রিপিটক বুঝাইবার জন্য ব্যবহৃত হইত। পরবর্তীকালে পালি ভাষায় রচিত সমস্ত গ্রন্থ বুঝাইবার জন্য ইহার প্রয়োগ হইতে থাকে। তবে যে সমস্ত গ্রন্থ ত্রিপিটকের সহিত জড়িত নহে তদসমুদয় বুঝাইবার জন্য পালি শব্দের প্রয়োগ হয় নাই। ক্রমে ক্রমে পালি ভাষায় রচিত সমস্ত গ্রন্থেরই একনাম 'পালি' বলিয়া পরিচিত হয়। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ভগবান বুদ্ধের বাণী ও ধর্মোপদেশ যে ভাষায় রক্ষিত ও প্রতিপালিত হইয়াছে সেই ভাষাকে 'পালি ভাষা' বলে। অথবা ভগবান বুদ্ধের উপদেশ এই ভাষায় পাঠ ও রক্ষিত এই অর্থে 'পালি' বলিয়া কথিত হয়। পাঠ > পালি > পাল > পালি ব্যাকরণের ব্যুৎপত্তিগত অর্থানুসারে 'সদ্দথং পালেতী'তি পালি'- যাহা শব্দার্থকে পালন অথবা রক্ষা করে উহারই নাম পালি।

'পল্লী' ভাষা পালি ভাষা। 'পল্লী' শব্দ হইতে 'পালি' শব্দের' উৎপত্তি হইয়াছে বলিয়া কেহ কেহ অনুমান করিয়া থাকেন। 'পল্লী' বা পাড়াগাঁয়ের ভাষা পালি- এই সম্বন্ধে কোনো যুক্তিসংগত কারণ আছে বলিয়া মনে হয় না। কারণ কেবল মাগধী প্রাকৃতেই 'র' পরিবর্তিত হইয়া 'ল'-এ পরিণত হইতে দৃষ্ট হয়, পালিতে ইহা খুব বিরল। উক্ত মত সম্ভবত বৌদ্ধ ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করিবার জন্য বৌদ্ধ-বিদ্বেষী পণ্ডিতের চক্রান্ত। আবার কাহারও মতে মগধ বা পাটলিপুত্রের নামানুসারে 'পালি' শব্দের উৎপত্তি হইয়াছে। 'পাটলি' শব্দের অপভ্রংশ পালি হইতে পারেনা। পল্লী বা পাড়াগাঁয়ের ভাষা পালি ভাষা এবং 'পল্লী শব্দ হইতে পালি ভাষার উৎপত্তি হইয়াছে- এইরূপ অনুমান হয়ত করা যাইতে পারে। তবে 'পল্লী বলিতে আমাদের আধুনিক গ্রাম মনে করিলে ভুল হইবে। গ্রামেরই বিশেষ অংশকে পল্লী বলা হয়। পালি কখনও একটি ক্ষুদ্র গ্রামের ভাষা হইতে পারেনা। পালি গ্রাম ও নগর উভয় স্থলেই কথিত হইত।

সংস্কৃত 'তন্ত্রি' বা 'তন্ত্রী' (পালি তন্তি) শব্দের মূল অর্থ হইল 'রজ্জু' বা 'সূত্র'। প্রাচীন ঋষিদের রচিত সুক্তসমূহ "সূত্র' নামে পরিচিত। যেমন, 'ব্রহ্মসূত্র', 'ন্যায়সূত্র' প্রভৃতি। 'তস্তি' বা 'তন্ত্রি' শব্দ একার্থক। এইজন্য কোনো কোনো পণ্ডিত অনুমান করেন 'তস্তি' অথবা সূত্র' হইতে পালি শব্দের উৎপত্তি। বৌদ্ধ সাহিত্যেও 'তন্তি' শব্দটি 'পালির' অন্যতম প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। যথা, যেতুস্মিং তন্তি তন্তীসু নারিযং পালি কথ্যতে'।সেইরূপে 'তস্তি যা মাতিকং ঠপেসি',; 'তন্তিবসেন মাতিকা ঠপিত্বা', 'তম্ভিবসেন বিভত্তা' ইত্যাদি। এইভাবে দেখা যায় 'তন্ত্র', 'তন্তী', 'সূত্র' শব্দের ন্যায় ত্রিপিটক শাস্ত্র বুঝাইবার জন্য 'পালি' শব্দের ব্যবহার হইয়াছে।

সমসাময়িক ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে আমরা দেখিতে পাই ভগবান বুদ্ধ কোশলে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তিনি ধর্ম প্রচারের জন্যও সমগ্র উত্তর ভারত পরিভ্রমণ করেন। বাঙলা-ভারত উপ-মহাদেশের বিচিত্র সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ভাষা ও আচার- অনুষ্ঠানের সহিত তিনি সর্বোতভাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁহার জীবদ্দশাতেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিহার ও সংঘারাম প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। শ্রাবস্তী, জেতবন, পূর্বারাম, বেণুবন, নালন্দা, চাপাল চৈত্য প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা তাঁহারই তত্ত্বাবধানে হইয়াছিল।

এই বিহারগুলি শুধু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসস্থল নয়, ইহা বৌদ্ধশাস্ত্র চর্চা ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিলন কেন্দ্রও ছিল। এইখানে থাকিয়া বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিবিধ শাস্ত্র (বহু সচ্চঞ্চ সিপপঞ্চ) অধ্যয়ন করিতেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে বহু নরনারী আসিয়া এইখানে ভিড় করিত। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সংকীর্ণ গণ্ডি ত্যাগ করিয়া সংঘারামের ভাষা ও সংস্কৃত শিক্ষায় মনোনিবেশ করিতেন। দীর্ঘদিন বিহার ও সংঘারামে বাস করায় তাঁহাদের আঞ্চলিক ভাষায় কথাবার্তা বলা অসুবিধা বোধ করিতেন। তাহা ছাড়া যাতায়াতের কিছুটা অসুবিধা থাকায় অন্য অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ততটা সুযোগ ছিল না। কাজে কাজেই কালক্রমে নিজেদের মধ্যে সহজে ভাব বিনিময়ের জন্য একটা মিশ্র নূতন ভাষার সৃষ্টি হইয়াছিল। ইহাই পালি ভাষা। এই ভাষায় বিহারে পাক্ষিক ধর্মালোচনা পাতিমোক্ষ আবৃত্তি হইত। এই ধর্মসভায় ভিক্ষুদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। এই কারণে সাধারণ ভিক্ষুদের বুঝিবার জন্য একটা সর্বজনবোধ্য ভাষার প্রয়োজনীয়তা ছিল অত্যধিক। তাই পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে এই বিহারগুলিতেই পালি ভাষার উৎপত্তি হয় এবং এই ভাষাতেই বৌদ্ধ শাস্ত্র ও ত্রিপিটক গ্রন্থ রচিত ও সংরক্ষিত হইয়াছিল।

অতএব আমরা দেখিতে পাই ভগবান তথাগত বুদ্ধ মাগধী ভাষায় তাঁহার নব ধর্ম প্রচার ও শিক্ষা দিয়াছিলেন। তদনুসারে বিভিন্ন অঞ্চলের ভিক্ষু-ভিক্ষুণীরা এই মাগধী প্রাকৃতকে কেন্দ্র করিয়া 'পালিভাষা' নামে এক মিশ্র ভাষার সৃষ্টি করেন। উত্তর ভারতে প্রচলিত (তৎকালীন) প্রায় সমস্ত ভাষার শব্দসম্ভারে এই নূতন ভাষা পুষ্ট ও পরিবর্ধিত। সুতরাং পালি কেবলমাত্র পল্লীর ভাষা এই মত গ্রহণযোগ্য নহে। বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণী, শ্রমণ ও শ্রামণেরীগণের পরস্পর যোগাযোগে সৃষ্ট ইহা এক প্রকার সংকর ভাষা। কথিত আছে ভগবান তথাগত বুদ্ধ এই ভাষাতেই তাঁহার উপদেশাবলী প্রচার করিয়াছিলেন।


সংগৃহীতঃ পালি সাহিত্যের ইতিহাস ১ম খণ্ড - রবীন্দ্রবিজয় বড়ুয়া


Facebook Page

Sunday, November 3, 2024

ভারতীয় আর্যভাষার স্তর ও শ্রেণীবিভাগ-পালি শব্দের অর্থ, পালি ভাষার উৎপত্তি-প্রাকৃত শব্দের অর্থ-প্রাকৃত ভাষার বৈচিত্র্য ও মূল্যায়ন

 


ভাষার ইতিবৃত্ত এবং শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে পালি এবং প্রাকৃত ভাষাসমূহ মধ্য ভারতীয়-আর্যভাষার (Middle Indo-Aryan) অন্তর্গত। ভারতীয়-আর্যভাষা ভারতীয়-আর্যভাষার একটি স্তর। মধ্য ভারতীয়-আর্যভাষার ইতিহাসে আমরা মোটামুটি তিনটি স্তর পাই:

(ক) প্রাচীন ভারতীয়-আর্যভাষা (Old Indo-Aryan): - সাধারণভাবে এই স্তর খৃঃ পূঃ ত্রয়োদশ শতক থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষা এই স্তরের অন্তর্গত।

(খ) মধ্য ভারতীয়-আর্যভাষা (Middle Indo-Aryan):- অশোকের অনুশাসন এবং অন্যান্য প্রতুলেখের (Inscription) ভাষা, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ প্রভৃতি এই স্তরের অন্তর্গত। খৃঃ পূঃ বষ্ঠ শতক থেকে খৃষ্টীয় দশম শতক পর্যন্ত এই স্তরের আনুমানিক কাল।

(গ) নব্য ভারতীয়-আর্যভাষা (New Indo-Aryan)-হিন্দী, বাঙলা, মারাঠী প্রভৃতি ভাষাকে এই স্তরে ধরা হয়। খৃষ্টীয় দশম শতক থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত এর বিস্তৃতি।

ভারতীয়-আর্যভাষার বিবর্তন বিশ্লেষণ করলে আমরা মধ্য ভারতীয়-আর্য ভাষাগুলির ক্রমবিবর্তন ও পরিণতির ক্ষেত্রে চারটি স্তর লক্ষ্য করি:

(i) প্রাচীন স্তর-খৃঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত। অশোকের অনুশাসনের ভাষা ও পালিকে এই স্তরে ধরা যায়।

(ii) পরিবৃত্তি স্তর (Transitional stage) - খৃঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক থেকে খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত। খরোধী, ব্রাহ্মী প্রভৃতি লিপিতে রচিত প্রতুলেখগুলির ভাষা এই স্তরভুক্ত।

(iii) দ্বিতীয় স্তর-খৃষ্টীয় দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত এই স্তরের মধ্যে শৌরসেনী, মাহারাষ্ট্রী, মাগধী, অর্ধমাগধী প্রভৃতি প্রাকৃত ভাষাগুলিকে ধরা যায়।

(iv) তৃতীয় স্তর-খৃষ্টীয় ষষ্ঠ থেকে দশম শতক পর্যন্ত বিস্তৃত এই স্তরে আমরা অপভ্রংশ প্রাকৃতকে ধরতে পারি।

পালি ও প্রাকৃত ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনা আমাদের কাছে সাধারণভাবে অনাদৃত। এই দুই ভাষায় রচিত বিপুল সাহিত্যের রসাস্বাদন করবার চেষ্টাও আমরা করি না। ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব আয়ত্ত করতে হ'লে পালি-প্রাকৃতের জ্ঞান অপরিহার্য। পালি-প্রাকৃতের বিশেষ চর্চা না করে বাংলা, হিন্দী, মারাঠী প্রভৃতি আর্য-ভাষামূলক আধুনিক ভারতীয় ভাষা- গুলিতে ব্যুৎপন্ন হওয়া যায় না। পালি-প্রাকৃতের সঙ্গে এই ভাষাগুলির সম্বন্ধ সংস্কৃতের সঙ্গে এদের সম্পর্ক অপেক্ষা ঘনিষ্ঠ।

জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর কবল থেকে মানুষকে মুক্ত করবার প্রয়াসে ভগবান্ বুদ্ধ যে 'সত্য' প্রচার করেছিলেন, যে 'ধর্ম' জগৎকে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল, যে ধর্মের অভ্যুদয়ে ভারতবর্ষের শিল্প, সাহিত্য, ও দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে নানা উন্নতি হয়েছিল, সেই বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বিশদ জ্ঞানলাভ করতে হ'লে পালি ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনা করা কর্তব্য। বৌদ্ধধর্মের মতই জৈনধর্মও ভারতবর্ষে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং আজও এদেশে বহুলোক এই ধর্ম অবলম্বন করে জীবন যাপন করেন। জৈনধর্মকে জানতে হ'লে আমাদের প্রাকৃতভাষা ও সাহিত্যের আলোচনা না করে উপায় নেই!

বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মে তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্যই যে কেবল পালি এবং প্রাকৃত সাহিত্যের আলোচনা প্রয়োজনীয়, তা নয়। এই দুই ভাষার সাহিত্য ভাণ্ডারে বহু উপাদেয় সম্পদ আছে, সাহিত্যরসিকের উপভোগ্য বহুবিধ গ্রন্থের রসাস্বাদন করবার সুযোগ আমরা পাই এই দুই সাহিত্যের চর্চা করলে। বৌদ্ধ-জৈনযুগের ভারতবর্ষকে জানতে হ'লে এবং ভারতীয় প্রাচীন দার্শনিক মতগুলি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে এই দুই সাহিত্য আমাদের জানতেই হ'বে। বহির্ভারতে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিজয়াভিযান শুরু হয়েছিল বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করেই। এই ধর্মের মূল বাহনরূপে পালি ভাষাও দিকে দিকে প্রসার লাভ করে। সিংহল, ব্রহ্মদেশ, শ্যাম, কম্বোজ প্রভৃতি দেশে পালি ও বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রভাব আজও লক্ষ্য করা যায়। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের একটি সুস্পষ্ট রূপ পেতে হ'লে আমাদের পালি-প্রাকৃত ভাষায় সংরক্ষিত উপাদানগুলির সাহায্য নিতেই হ'বে।

পালি শব্দের মূল অর্থঃ 

'পালি' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এবং পালিভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে পণ্ডিতমহলে বিশেষ মতভেদ আছে। পঙক্তি, বীথি, শ্রেণী প্রভৃতি অর্থে 'পালি' শব্দের প্রয়োগ আছে। 'পালি' শব্দ প্রথমতঃ বৌদ্ধশাস্ত্রের মূলশাস্ত্রকে এবং পরে মূলশাস্ত্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত যে কোনও গ্রন্থকে বোঝাতে ব্যবহৃত হোত। এমন কথাও অনেকে বলেন যে মূলশাস্ত্র 'পালি' বলে, যে ভাষায় ঐ মূল বা 'পালি' লেখা হয়েছিল তাকেই কালক্রমে পালিভাষা বলা হ'ল। 'পালি' শব্দটির প্রথম প্রয়োগ আমরা বুদ্ধঘোষের অট্ঠকথার মধ্যে পাই। এই শব্দটির বহুপ্রকার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ করার চেষ্টা হয়েছে এবং বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর 'পালিপ্রকাশ' গ্রন্থে এ সম্বন্ধে খুব ভালোভাবে আলোচনা করেছেন।

পালি ভাষার উৎপত্তিঃ

পালি ভাষার উৎপত্তি কী করে হ'ল এবং এটি কোন্ অঞ্চলের ভাষা এ নিয়েও পণ্ডিতমহলে বিশেষ মতভেদ দেখা যায়। পালি একটি মিশ্র ভাষা এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ভাষার সাদৃশ্যধর্ম লক্ষ্য করে পণ্ডিতরা বিভিন্ন মত দিয়েছেন। উজ্জয়িনীকেই পালির উৎপত্তিস্থল বলে মনে করেছেন Westergaard, Kuhn প্রমুখ পণ্ডিতগণ পৈশাচীর সঙ্গে এর সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন Sten Konow; Oldenburg প্রমুখরা পালিকে কলিঙ্গের ভাষা বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন; Lüders বলেন অর্ধমাগধীর মূল প্রাচীন রূপ থেকে অনুবাদ করেই পালি সাহিত্যের সৃষ্টি; Geiger, Windisch প্রমুখ সিংহলী ঐতিহ্যকে স্বীকার করে মনে করেন বৌদ্ধধর্মের পীঠভূমি মগধই হ'ল পালির উৎপত্তিস্থল এবং মাগধীই হ'ল মূলভাষা, আবার সুনীতি চট্টোপাধ্যায় মনে করেন পালি হল পশ্চিমা ভাষা এবং শৌরসেনী প্রাকৃতেরই প্রাচীনতর রূপ। এই মতগুলির মধ্যে কোনটিই পণ্ডিতমহলে সন্তোষজনকভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। মাগধীর পক্ষে মতামতের পাল্লা ভারী হ'লেও ব্যাকরণ, প্রতুলেখ বা নাটকের মধ্যে আমরা যে মাগধী প্রাকৃতের পরিচয় পাই তার সঙ্গে পালির বিশেষ মিল দেখা যায় না।

'প্রাকৃত' শব্দের মূল অর্থঃ

'পালি'র মত 'প্রাকৃত' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নিয়েও নানা পণ্ডিতের নানা মত'! 'প্রকৃতিতে যাহা জাত' বা 'প্রকৃতি হইতে যাহা আগত' তার নামই 'প্রাকৃত'। অনেকে বলেন এই 'প্রকৃতি' হ'ল সংস্কৃত ভাষা এবং 'প্রাকৃত' ভাষা হল সংস্কৃতের বিকৃতি। কারও মতে আবার 'প্রকৃতি' অর্থাৎ স্বভাব থেকে যে ভাষা এসেছে তারই নাম 'প্রাকৃত'। যে ভাষার 'সংস্কার' বা গুণাধান করা হয়েছে তা' হ'ল 'সংস্কৃত' এবং যে ভাষা নৈসর্গিক বা স্বাভাবিক অবস্থায় আছে এবং যার কোন 'সংস্কার' করা হয়নি তা-ই হ'ল 'প্রাকৃত'। আর এক মতে সাধারণ 'প্রাকৃত' লোকের ব্যবহৃত ভাষাই 'প্রাকৃত' ভাষা। বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় পালি প্রকাশ গ্রন্থে এ বিষয়েও বিশদ আলোচনা করেছেন।

প্রাকৃত ভাষার বৈচিত্রা ও মূল্যায়ন:

'প্রাকৃত' ভাষার নানা বিভাগ আছে। ব্যাপক অর্থে পালিও অন্যতম প্রাকৃত ভাষা, এবং প্রাকৃত ভাষা বলতে আমরা যে ভাষাগুলিকে গ্রহণ করি ভাষাতত্ত্বের বিচারে পালিভাষা সেই প্রাকৃত ভাষা অপেক্ষা প্রাচীন। ধর্মীয় প্রাকৃত, সাহিত্যিক প্রাকৃত, নাটকে ব্যবহৃত প্রাকৃত, ব্যাকরণে উল্লিখিত প্রাকৃত, বর্হিভারতীয় প্রাকৃত, প্রতুলেখ-প্রাকৃত, অশোক-প্রাকৃত, প্রভৃতি নানা বিভাগে প্রাকৃত-ভাষাকে ভাগ করা যায়। পালির ন্যায় প্রাকৃতও আমাদের কাছে অনাদৃত একথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাকৃত কাব্যের সমৃদ্ধি এবং প্রাচীনেরা প্রাকৃত কাব্যের কত প্রশংসা করেছেন তার কোন খবরই আমরা রাখি না। বিষয় বৈচিত্র্যেও প্রাকৃত ভাষা অন্ত কোন ভাষার চেয়ে দীন নয়। মনে রাখা দরকার দ্রাবিড়ভাষী দক্ষিণ ভারতে প্রাকৃত ভাষার বিপুল প্রভাব ছিল এবং খৃষ্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত সাতবাহন ও পরবর্তী রাজাদের প্রশাসন কার্য প্রাকৃত ভাষাতেই সম্পন্ন হোত। খৃঃ পূঃ চতুর্থ শতক থেকে খৃষ্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত আমরা যে যে প্রধান প্রত্নলেখ, মুদ্রালিপি ইত্যাদি পাই তা' প্রধানতঃ প্রাকৃতেই রচিত। এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে ভারতীয় রচনার প্রথম পাঠযোগ্য লিখিত প্রমাণ আমরা প্রাকৃত ভাষাতেই পাইন। এখানে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে পালি ভাষায় যা কিছু রচিত সবই মুখ্যতঃ বৌদ্ধ ধর্মকে ভিত্তি করে, কিন্তু প্রাকৃত সাহিত্য সম্বন্ধে এ কথা বলা যায় না। জৈন প্রাকৃত বা অর্ধ মাগধীতে যেমন রচিত হয়েছে বিপুল জৈনশাস্ত্র, তেমনই অন্যান্য প্রাকৃতে রচিত হয়েছে দশমুহবহো, গউড়বহো প্রভৃতির মত উৎকৃষ্ট কাব্যগ্রন্থ। সিদ্ধাচার্যরা তাঁদের জ্ঞান ও সাধনার কথা প্রকাশ করেছেন অপভ্রংশে, আর অশ্বঘোষ, ভাস, শূদ্রক, কালিদাস প্রমুখ সংস্কৃত নাট্যকারেরা বিভিন্ন সাহিত্যিক প্রাকৃত ব্যবহার করেছেন তাঁদের সংস্কৃত নাটকে এবং রাজশেখর প্রাকৃতে কপূরমঞ্জরীর মত নাটক (সট্রক) রচনা করেছেন। এ ছাড়া রয়েছে পূর্বোল্লিখিত প্রত্নলেখগুলি, যাদের সংখ্যা হ'বে প্রায় দেড় হাজার। ভাষাতত্ত্ব ছাড়া ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এই প্রভুলেখগুলির বিশেষ মূল্য আছে। বাঙলা দেশে বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্যের এবং পালিভাষার আলোচনায় অল্পবিস্তর আগ্রহ দেখা গেলেও জৈন ধর্ম ও সাহিত্যের এবং প্রাকৃত ভাষার চর্চা বাংলা দেশে একরকম নেই বললেই হয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এই অবস্থার পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা কর্তব্য।

১. S. K. Chatterjee, Origin and Development of the Bengali

Language, Pp. 16 ff.

সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত, পৃঃ ৮৬

২. S. K. Chatterjee, ঐ 

৩. বিধুশেখর শাস্ত্রী, পালি প্রকাশ, প্রবেশক, পৃঃ ১-১০

8. Geiger (Tr. B. K. Ghosh), Pali Language and Literature, p. 1-7

বিধুশেখর শাস্ত্রী, ঐ পৃঃ ১১-১৩; Winternitz, History of Indian Lit. II, p. 18

S. K. Chatterjee, ঐ; B. C. Law, A History of Pali Lit. I, Introduction.

৫. "সা মাগধী মূলভাসা নরা যা' আদিকপ্লিকা..।" পয়োগসিদ্ধি, মহারূপসিদ্ধি প্রভৃতি ব্যাকরণে এই শ্লোকটি উল্লিখিত।

৬. বিধুশেখর শাস্ত্রী, ঐ, পৃঃ ১৩-১৭

৭. Woolner, Introduction to Prakrit, p. 3

বিধুশেখর শাস্ত্রী, ঐ, পৃঃ ১৮-২০

৮. বিধুশেখর শাস্ত্রা, ঐ, পৃঃ ১৮-৩৫

৯. সুকুমার সেন, ঐ, পৃঃ ৮৯-৯২; পরেশচন্দ্র মজুমদার, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ, পৃঃ ২৫০


সংগৃহীতঃ পালি সাহিত্যের ইতিহাস (রবিন্দ্র বিজয় বড়ুয়া)

অ- বর্ণের অভিধান - ২

  অকতাগস [ অকত+আগস] পাপ না করিয়া। =>  আগু, আগস । অকতাভিনিবেস (বিণ) অমনোযোগী। => কতাভিনিবেস । অকত্তব্ব (বিণ) অকর্তব্য, অনুচিত, যাহা কর...